ময়মনসিংহ জেলা

বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত ময়মনসিংহ জেলা প্রাচীন ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য সুপরিচিত। এর ভৌগোলিক অবস্থান 24°38’3″ উত্তর অক্ষাংশ এবং 90°16’4″ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। এই জেলার প্রধান শহর, ময়মনসিংহ শহর, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তর নগরী হিসেবে পরিচিত। ১৩টি উপজেলা, ১৪টি পৌরসভা এবং ২,১০১টি গ্রামের প্রশস্ত এই জেলা বাংলাদেশের কৃষি ও মৎস্য চাষের জন্য বিখ্যাত।

ময়মনসিংহ জেলার ইতিহাস ১৭৮৭ সালের ১ মে থেকে শুরু হয়, এবং জেলা জুড়ে শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে, যার প্রমাণ জেলার ৭৪.০৮% সাক্ষরতার হার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ এবং ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখানে অবস্থিত, যা এ জেলার শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

ভূগোল ও অবস্থান

ময়মনসিংহ জেলার সীমানা উত্তর দিকে নেত্রকোনা এবং গাজীপুর, দক্ষিনে টাঙ্গাইল, পশ্চিমে জামালপুর ও শেরপুর এবং পূর্বে কিশোরগঞ্জ জেলার সাথে মিলিত। জেলাটি ভৌগোলিক ভাবে ২৪.৮৮১৮৭৪° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০.৭২৭৪৯০° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।

পৃথিবী ও অভ্যন্তরীণ কাঠামো

ময়মনসিংহ জেলার মোট আয়তন প্রায় ২৯.৪ বর্গকিলোমিটার। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা ১,২২,২৭৯ জন, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতিকিলোমিটারে প্রায় ৪২০০ জন। জেলার সীমানার মধ্যে বিভিন্ন নদী ও জলাশয় রয়েছে, প্রধান নদীগুলির মধ্যে ব্রহ্মপুত্র এবং সোমেশ্বরী নদী উল্লেখযোগ্য।

  • ব্রহ্মপুত্র নদী: ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম প্রধান নদী।
  • সোমেশ্বরী নদী: এ নদীও জেলার বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত হয়েছে।
  • ছোট ছোট জলাশয়: ভাওয়াল জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট ছোট অনেক জলাশয় রয়েছে।

বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ের অবস্থান জেলার সীমানা মধ্যে ভৌগোলিক ও পরিবেশগত সমৃদ্ধ নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ময়মনসিংহ শহর থেকে নেত্রকোনা পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার যা জেলার অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

আরও পড়ুনঃ  আবদুল হামিদ খান ভাসানী: একটি পরিচিতি

ইতিহাসের পটভূমি

ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে হলে, আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ১,১০০ বছর পূর্বে। ময়মনসিংহ জেলা আসলে ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। এখানে পাওয়া যায় পৌরাণিক কাহিনী এবং বিভিন্ন মিথলজির উল্লেখ।

এই সমৃদ্ধ ইতিহাসের প্রথম দিকে দেখা যায় বৌদ্ধ শাসনের প্রভাব। পরে পাল রাজবংশ ক্ষমতায় আসে, যার প্রভাব ময়মনসিংহ অঞ্চলে দৃশ্যমান। পাল রাজবংশ শাসন করার সময় ময়মনসিংহ অঞ্চলে শিক্ষার প্রসার ঘটে।

ব্রিটিশ শাসনের সময় ময়মনসিংহ জেলা একটি মহকুমা হিসেবে পরিচিতি পায়। শিক্ষায় এবং প্রশাসনে ব্যাপক উন্নতি হয়। এই সময়ে ময়মনসিংহে বেশ কিছু প্রখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা হয়, যেমন:

  • ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ
  • আনন্দমোহন কলেজ
  • বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতিহাস হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম শাসকদের অধীনে সময়কালের সব ধরনের পরিবর্তন ও পর্যায়াবলীর সাক্ষী হয়েছে। প্রাচীন যুগের থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত এ অঞ্চলটি বিভিন্ন রাজাদের শাসনে ছিল; যেমন সেন রাজবংশ, সুলতানি আমল এবং মুঘল শাসনের সময়ে অপরিহার্য অংশ ছিল।

ময়মনসিংহ জেলা ১ মে, ১৭৮৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সময়ে এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ জেলা ছিল। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সাব-ডিভিশনে বিভক্ত হয়ে বর্তমান আকারে পরিণত হয়। ১৮৬৪ সালের পরে এটি ছয়টি পৃথক জেলায় বিভক্ত হয়: ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা এবং কিশোরগঞ্জ।

ময়মনসিংহের ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এ অঞ্চলে জন্ম নেওয়া কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের অবদান। কাজী নজরুল ইসলাম, দীনেশ চন্দ্র সেন, কবিকঙ্কন মুখার্জী প্রমুখ ব্যক্তিত্বেরা ময়মনসিংহের গর্ব। এছাড়াও স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, যেমন: আব্দুল রশিদ, ইদ্রিস আলী, চান মিয়া ইত্যাদি।

এই প্রাচীন ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ময়মনসিংহের বর্তমান সংস্কৃতি ও জীবনে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতিহাস শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, এটি আজকের জেলা এবং এ অঞ্চলের মানুষের আত্মপরিচয়ের অংশ।

আরও পড়ুনঃ  লালবাগের কেল্লা

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য

ময়মনসিংহ জেলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই অঞ্চলের স্থানীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান স্থানীয় মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ময়মনসিংহে পয়লা বৈশাখ এবং অন্যান্য প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উৎসব জমকালো এবং উদযাপনমূলকভাবে পালিত হয়। এছাড়াও, বসন্ত উৎসব এবং নবান্ন উৎসবের মতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলিও এখানকার সংস্কৃতির অংশ।

ময়মনসিংহে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক রীতির মধ্যে বাউল গান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাউল গানের মাধ্যমে মানব জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। এছাড়াও, যাত্রাপালা এবং গাজীর গান ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বাহক। বিভিন্ন গ্রাম্য নাটক এবং পালা এই অঞ্চলের মানুষদের বিনোদনের অন্যতম উৎস।

ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলা ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোণা এবং শেরপুরে বিভক্ত। প্রতিটি জেলার স্থানীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বহন করে। ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই শহরটি বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক, শিক্ষা এবং বিজ্ঞান কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়।

ময়মনসিংহের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে শশী লজ, ময়মনসিংহ জাদুঘর, ভিজয়পুর চায়না মাটির পাহাড়, হাসান মঞ্জিল এবং গজনী অবকাশ কেন্দ্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সমস্ত স্থানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে, যারা ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসেন।

ময়মনসিংহের বিভিন্ন জনপ্রিয় গানের মধ্যে মালঞ্চ গীতি, মহুয়া গীতি এবং কদম গীতি উল্লেখযোগ্য। এই গানগুলো ময়মনসিংহের সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অংশ। স্থানীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান উপলক্ষে এই গানগুলো গাওয়া হয় এবং এখানকার সঙ্গীত প্রেমীদের মনোরঞ্জন করে।

অর্থনীতি ও কৃষি

ময়মনসিংহ জেলার অর্থনীতি প্রধানত কৃষিভিত্তিক। জেলাটিতে ধান, পাট এবং মাছের চাষ ব্যাপকভাবে প্রচলিত। মায়মনসিংহের কৃষিকাজে প্রধান খাতসমূহ ধান ও পাটের উৎপাদন। উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে অবস্থিত, যা দেশের অন্যতম প্রধান কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এটি কৃষিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার সহায়তায় উৎপাদন ও কৃষকদের জীবনমান বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করছে।

ময়মনসিংহ বিভাগের অন্যান্য জেলা যেমন জামালপুর এবং শেরপুরের অর্থনীতিও প্রধানত কৃষিনির্ভর। জামালপুরে প্রধান খাতসমূহ পাটের চাষ, ধান, গম ও সবজির উৎপাদন। শেরপুরে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৃষির পাশাপাশি লোকসংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। নেত্রকোনা জেলার অর্থনীতি এবং জীবনের সাথে প্রধান খাতসমূহ ধান, পাট, সবজি এবং মাছের চাষ সম্পর্কিত।

আরও পড়ুনঃ  সোনারগাঁও: একটি ঐতিহাসিক পর্যটন স্থান

ময়মনসিংহ জেলায় মাছ চাষ, বিশেষত তেলাপিয়া মাছের উৎপাদন দেশে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাছ চাষে উন্নত পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সহায়তায় এই অঞ্চলের নদ-নদী ও পুকুরগুলোতে ব্যাপক মাছ উৎপাদন হয়, যা স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

ময়মনসিংহের প্রধান খাতসমূহ পর্যটন আকর্ষণগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী অঞ্চল, শশীলজ, মুক্তাগাছা, জমিদার বাড়ি এবং আলেকজেন্ডার ক্যাসেল উল্লেখযোগ্য। এ পর্যটন কেন্দ্রগুলি স্থানীয় ও বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

FAQ

ময়মনসিংহ জেলার প্রধান শহর কোনটি?

ময়মনসিংহ জেলার প্রধান শহর হলো ময়মনসিংহ শহর, যেটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তর নগরী।

ময়মনসিংহ জেলার প্রধান নদী ও জলাশয় কোনগুলি?

ময়মনসিংহ জেলার প্রধান নদীসমূহ হল ব্রহ্মপুত্র নদ, সোমেশ্বরী নদ প্রভৃতি এবং ছোট বড় অনেক জলাশয়।

ময়মনসিংহ জেলার সীমানা কি কি?

ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে নেত্রকোনা এবং গাজীপুর, দক্ষিণে টাঙ্গাইল, পশ্চিমে জামালপুর ও শেরপুর এবং পূর্বে কিশোরগঞ্জ জেলার সাথে ঘেরা।

ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতিহাসে কি কি উল্লেখযোগ্য?

ময়মনসিংহ জেলা আনুমানিক ১,১০০ বছরের প্রাচীন অতীতের সাক্ষী। এখানে পৌরাণিক কাহিনী ও মিথলজির বিভিন্ন উল্লেখ পাওয়া যায়।

ব্রিটিশ আমলে ময়মনসিংহ জেলার কলোনিয়াল প্রভাব কিরূপ ছিল?

ব্রিটিশ রাজত্বের সময় ময়মনসিংহ জেলা একটি মহকুমা হিসাবে পরিচালিত হতো এবং শিক্ষা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়।

ময়মনসিংহের স্থানীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান কি কি?

ময়মনসিংহে বসন্ত উৎসব, নবান্ন উৎসব এবং বিভিন্ন পৌরাণিক রীতিনীতিগুলো ব্যাপকভাবে পালিত হয়।

ময়মনসিংহের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক রীতি কি কি?

ময়মনসিংহের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক রীতি হল বাউল গান, যাত্রাপালা এবং গাজীর গান যা এই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির অংশ।

ময়মনসিংহ জেলার অর্থনীতি এবং প্রধান খাতসমূহ কি কি?

ময়মনসিংহ জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি, মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদের উপর নির্ভরশীল। জেলায় কৃষিকাজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button