রেমিট্যান্স কি?
অর্থ প্রেরণ বা রেমিট্যান্স, বৈশ্বিক অর্থনীতির এক অন্যতম অধ্যায়। এর মাধ্যমে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের মূল দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করে। আন্তর্জাতিক অর্থের প্রবাহ ঘটে যখন অভিবাসী কর্মীরা তাদের সামাজিক ও আর্থিক দায়বদ্ধতা সামলে প্রবাসী রেমিট্যান্স কে উন্নয়নশীল বা স্বদেশের মানুষের কল্যাণে প্রেরণ করে। প্রবাসীদের এই অর্থের প্রবাহ অনেকগুলো দেশের জন্য জাতীয় আয়ের এক বড় অংশ হিসেবে গণ্য হয়, যা জাতীয় উন্নয়নের চিত্র পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বর্তমান সময়ে, বাংলাদেশ সহ অনেক দেশ রেমিট্যান্স প্রাপ্তির দিক থেকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে ভারত ($১০০ বিলিয়ন), মেক্সিকো ($৬০ বিলিয়ন), চীন ($৫১ বিলিয়ন), ফিলিপাইন ($৩৮ বিলিয়ন), মিশর ($৩২ বিলিয়ন), এবং পাকিস্তান ($২৯ বিলিয়ন) অর্থ প্রেরণের শীর্ষ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্সের প্রবাহ ২০০১ সালের $৭২.৩ বিলিয়ন থেকে ২০১১ সালে প্রায় $৪৮৩ বিলিয়নে পৌঁছেছে, যা ২০১৮ সালে ১০% বৃদ্ধি পেয়ে $৬৮৯ বিলিয়নে উন্নীত হয়, এর মধ্যে $৫২৮ বিলিয়ন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে চলে গেছে। এই পরিসংখ্যানগুলি দেখায় কিভাবে রেমিট্যান্স গ্লোবাল একোনোমির মূল ধারার স্বার্থকাঙ্ক্ষা পুরণে অবদান রাখছে এবং বিশ্বব্যাপী সমাজগুলির মুখ বদলাচ্ছে।
রেমিট্যান্সের সংজ্ঞা
রেমিট্যান্স হলো প্রবাসী অর্থ প্রেরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবাহ বৃদ্ধি ও বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক পুঁজি প্রবাহ নির্ভর পদ্ধতি যা শ্রম বাজারের বিভিন্ন দেশের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে। এই প্রক্রিয়াটি শ্রমিক এবং পেশাজীবীদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়, যারা বিদেশে উপার্জন করে তাদের আয়ের একটি অংশ নিজ দেশে পাঠিয়ে থাকেন।
রেমিট্যান্সের ইতিহাস
রেমিট্যান্সের ইতিহাস ব্যাপক এবং গভীর। প্রাচীন যুগ থেকেই বিভিন্ন সভ্যতায় শ্রমিকরা তাদের উপার্জিত অর্থ পাঠিয়ে আসছে, যা তাদের পরিবার ও সামাজিক কল্যাণ নির্ভরশীল ছিল। বর্তমান যুগে, উন্নত ব্যাংকিং ও ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে এই প্রেরণ প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত এবং নিরাপদ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সিস্টেম
রেমিট্যান্স বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সিস্টেমের এক অন্যতম অংশ হিসেবে কাজ করে। এটি বিভিন্ন দেশের মধ্যে আর্থিক সম্পর্ক তৈরি করে, যা সামগ্রিক্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। রেমিট্যান্স প্রেরণের মাধ্যমে, প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের নিজ দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহকে সমর্থন ও বৃদ্ধি করে থাকেন, যা বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রগতির প্রেরণা যোগায়।
রেমিট্যান্সের প্রকারভেদ
রেমিট্যান্স বিভিন্ন রূপে প্রেরিত হতে পারে, যা প্রেরক এবং গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। প্রধান তিনটি প্রকারের মধ্যে রয়েছে শ্রমিকের অর্থ প্রেরণ, ব্যাংকিং অর্থ প্রেরণ এবং ডিজিটাল অর্থ প্রেরণ। প্রতিটি প্রকারভেদ বিশেষ কিছু সুবিধা প্রদান করে থাকে যা গ্রাহকদের নিরাপদ ও সহজ উপায়ে অর্থ প্রেরণে সহায়তা করে।
শ্রমিকের রেমিট্যান্স
এই প্রকারের রেমিট্যান্স মূলত প্রবাসী কর্মীদের দ্বারা তাদের পরিবার বা স্বজনদের প্রতি পাঠানো হয়। এটি তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সাহায্য করে এবং আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করে। শ্রমিকের অর্থ প্রেরণ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ব্যাংকিং রেমিট্যান্স
ব্যাংকগুলি তাদের নিরাপদ চ্যানেল ব্যবহার করে অর্থ প্রেরণের সুবিধা প্রদান করে। গ্রাহকরা এই পদ্ধতিতে বিশ্বাস রাখেন কারণ এটি নিরাপত্তা এবং সরকারভুক্ত নির্দেশনাবলীর মাধ্যমে অনুমোদিত। এই পদ্ধতি দ্বারা অর্থ প্রেরণ করা হয় সহজে এবং নিরাপদে।
ডিজিটাল রেমিট্যান্স
ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল অর্থ প্রেরণ একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হয়ে উঠেছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন গ্রাহকদের তাদের অর্থ সুরক্ষা এবং দ্রুত প্রেরণের সুযোগ প্রদান করে। এই পদ্ধতি সময় বাঁচায় এবং অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে, যেমন ট্রানজেকশন ইনভয়েস প্রদর্শন, স্বয়ংক্রিয় লেনদেনের পূর্বানুমোদন, এবং ক্রেডিট কার্�
রেমিট্যান্স কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বৈশ্বিক অর্থনীতির আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে রেমিট্যান্স একটি উল্লেখযোগ্য নাম। এই রেমিট্যান্স শুধু মাত্র প্রেরক ও গ্রহীতার মধ্যকার লেনদেন নয়, বরং এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে সমগ্র অর্থনীতি ও সমাজের ওপর।
অর্থনীতিতে প্রভাব
রেমিট্যান্স অনেক দেশের জন্য জিডিপির বৃদ্ধির একটি প্রধান উৎস। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, রেমিট্যান্স আয় মুদ্রার ভাণ্ডার বৃদ্ধি, অর্থনীতির উন্নতি এবং একাধিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রকল্পে অর্থায়নে ব্যবহৃত হয়। এটি দেশের পরিবর্তনের এক অন্যতম চালিকাশক্তি।
সামাজিক দিক
রেমিট্যান্সের প্রভাব সামাজিকভাবেও অপরিসীম। সামাজিক উন্নয়ন এর পাশাপাশি এটি পরিবারগুলির জীবনমান বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অবস্থার উন্নতি নিয়ে আসে। দারিদ্র্য হ্রাস পায় এবং জনগণের মোট আয় বৃদ্ধি পায়।
- পারিবারিক আর্থিক স্থিতিশীলতা
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে সহায়ক
- সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় অবদান
সমগ্রভাবে, রেমিট্যান্স একটি দেশের জিডিপির বৃদ্ধি এবং সমাজের উন্নয়নে অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি না কেবল মৌলিক অর্থনৈতিক কাঠামো বদলায়, বরং জনজীবনের মানোন্নয়নেও অবদান রাখে।
রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া
রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া আধুনিক প্রযুক্তি ও বিভিন্ন মেথডের মাধ্যমে আরও সুগম ও নিরাপদ হয়ে উঠেছে। আমাদের নিত্য দিনের আর্থিক লেনদেনের অঙ্গ হিসেবে এখন তার-বিহীন প্রেরণ ও ডিজিটাল অর্থ প্রেরণের প্লাটফর্মগুলি অপরিহার্য।
বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যাখ্যা
রেমিট্যান্স পাঠাতে গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন পথ এবং প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলঃ
- ব্যাংক ট্রান্সফার: সাধারণভাবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করা হয়, যা নিরাপদ এবং বিশ্বাসযোগ্য।
- মোবাইল মানি সার্ভিস: bKash, Rocket এর মতো মোবাইল অর্থ প্রদান সেবা, যা দ্রুত ও সহজ।
- ডিজিটাল প্লাটফর্ম: Wise, PayPal, যেখানে কম খরচে অর্থ পাঠানো যায়।
কমিশন এবং চার্জ
আর্থিক পরিষেবা চার্জ এবং কমিশনগুলি প্রায়ই উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকে, কারণ এগুলি অনেক সময় প্রেরিত টাকার একটা বড় অংশ নেয়। বিভিন্ন প্লাটফর্ম এবং পদ্ধতি ভেদে এই চার্জগুলির পরিমাণ পরিবর্তন হয়:
- bKash: কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই প্রতিদিন ৫০ বিডিটি থেকে ১২,৫০,০০০ বিডিটি পর্যন্ত পাঠানো যায়।
- Western Union, MoneyGram: বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রেরণে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বব্যাপী পরিষেবা প্রদান করে।
- রিয়া এবং অন্যান্য ডিজিটাল সার্ভিসেস: যা ভিন্ন ভিন্ন দেশের মধ্যে দ্রুত ও সহজে অর্থ প্রেরণের সুযোগ প্রদান করে।
সঠিক পদ্ধতি এবং প্লাটফর্ম নির্বাচন করে, গ্রাহকরা তাদের অর্থ স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে আরও অর্থকরী ও কার্যকর করতে পারে।
বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের পরিমাণ
বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্প্রতি বৈশ্বিক অভিবাসীদের রেমিট্যান্স প্রেরণের মাধ্যমে অভূতপূর্বভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। রেমিট্যান্সের পরিমাণ দরূন বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিকেও এক নতুন মাত্রা দিয়েছে।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান
২০২২ সালে, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় গত বছরের তুলনায় ১০.২% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে যায়। এ সময়ে মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৪৭৭ কোটি ডলার।
ভৌগোলিক বিতরণ
ভৌগোলিক দিক থেকে সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য এবং মালয়েশিয়া থেকে আসা রেমিট্যান্স বাংলাদেশে প্রধান অবদান রাখছে। এই দেশগুলি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দেশের মোট রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ নির্ধারণ করে। উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি থেকেও একটি বৃহৎ হারে রেমিট্যান্স আগমন ঘটেছে।
সামুদ্রিক দূরত্ব অতিক্রম করে আসা এই অর্থ বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতির একটি প্রধান ধারক এবং বাহক হিসেবে কাজ করছে, এবং রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশটির বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভ আরও মজবুত হচ্ছে।
রেমিট্যান্সের সুবিধা ও অসুবিধা
রেমিট্যান্সের এক প্রধান সুবিধা হল এর অর্থনৈতিক প্রভাব যা দেশের মোট অর্থনীতির শক্তি বাড়িয়ে দেয়। যেমন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রেমিট্যান্সের প্রায় ৬৩% অর্থ ব্যয়ে দৈনন্দিন খরচের খাতে যোগ হতে পারে যা একটি পরিবারের আয়ের পরিমাণকে প্রায় ৮২% পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম। এটি বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে দেশের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও, রেমিট্যান্স বাংলাদেশের মৌলিক চাহিদা, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশু পুষ্টি এবং শিক্ষা খাতের জন্যে জরুরি অর্থায়ন প্রদান করে। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের ৫৬% অনিয়মিত চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠানো হয়, যদিও গ্রামীণ অঞ্চলে উন্নয়নের কারণে ফর্মাল চ্যানেলের ব্যবহার বেড়েছে।
সুবিধাগুলি
রেমিট্যান্সের অর্থনৈতিক প্রভাব গভীর ও মৌলিক। বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থ ব্যক্তিগত পর্যায়ে চূড়ান্ত জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বাসস্থানে বিনিয়োগের মতো উপাদানগুলির প্রতি অবদান রাখে।
অসুবিধাগুলি
অসুবিধা হিসেবে, উচ্চ ফিস ও চার্জের প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য। অনেক সময় প্রবাসী কর্মীরা রিস্ক ফেস করতে হয় এবং অবৈধ চ্যানেল যেমন হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণের সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে।