খেলাপি ঋণ কি?
আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ একটি সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যা প্রায়শই ঋণ পরিশোধে বিলম্ব কিংবা ডিফল্টের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই ধরনের ঋণের খেলাপি হওয়ার ফলে অর্থনীতির উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি হয়। ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত, ভারতের NPA পরিস্থিতি হ’ল 1.96 লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী সম্পদ হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। ব্যাঙ্কিং সেক্টরে এমন একটি চিত্র নিঃসন্দেহে আমাদের অর্থনীতি খেলাপি ঋণের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
বাংলাদেশে, সম্প্রতি, ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০.১১% খেলাপি ঋণে পরিণত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, যা দেখা যাচ্ছে যে ঋণ খেলাপির প্রবণতা বেড়েছে। এ থেকে আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, বাংলাদেশের ব্যাঙ্কগুলিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিগত কয়েক বছরে লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিষয়ে সচেতনতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা এটির সমাধানের চাবিকাঠি হতে পারে।
খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা
খেলাপি ঋণ একটি প্রাতিষ্ঠানিক শব্দ, যা ব্যাংক ঋণের অনিয়মিততা থেকে উদ্ভূত হয়। যখন একটি ঋণ গ্রহীতা ঋণের মানদণ্ড অনুসারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণের কিস্তি, সুদ অথবা মূলধন পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাকে খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াতে ফেলা হয়। এটি ব্যাংকের মূল আর্থিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
ঋণের অর্থ ও ভূমিকা
ঋণ হলো একটি আর্থিক লেনদেনের প্রক্রিয়া যেখানে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নির্ধারিত সময়ের জন্য অর্থ প্রদান করে। এই প্রক্রিয়ায়, ঋণ গ্রহীতাকে চুক্তি অনুযায়ী মূলধন এবং সুদ পরিশোধের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ঋণের মানদণ্ড এবং ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে এই প্রক্রিয়া নির্ধারিত হয়।
খেলাপি ঋণকে কিভাবে চিহ্নিত করা হয়?
খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ একটি প্রক্রিয়া যেখানে ব্যাংকগুলি তাদের নিয়মিত লেখাপত্র পর্যালোচনা করে এবং যাচাই করে দেখে যে কোন ঋণগ্রহীতা তাদের চুক্তিবদ্ধ মেয়াদের মধ্যে ঋণের অর্থ পরিশোধ করেছে কি না। যদি ঋণগ্রহীতার কিস্তি বা পরিশোধে বিলম্ব হয়, তাহলে সেই ঋণটি খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রক্রিয়া, ব্যাংক ঋণের অনিয়মিততা মনি্েটরিং এবং ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
খেলাপি ঋণের প্রকারভেদ
বাংলাদেশে ঋণের বিভিন্ন ধরণের মধ্যে খেলাপি ঋণের সমস্যা একটি গুরুতর বিষয়, যার প্রধান কারণগুলি প্রায়শই ঋণগ্রহীতার অক্ষমতা বা অনিচ্ছা থেকে উদ্ভূত হয়। এই প্রকরণে বিভিন্ন ধরণের খেলাপি ঋণ নিয়ে আলোচনা করা হবে, যাতে পাঠকদের সাথে তথ্য ভাগাভাগি করা যায়।
ব্যক্তিগত ঋণ
ব্যক্তিগত ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যখন ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব খরচ, যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা বা যাত্রা ব্যয় ইত্যাদির জন্য ঋণ নেন এবং সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন।
ব্যবসায়িক ঋণ
ব্যবসায়িক ঋণ খেলাপি ঘটে থাকে যখন কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসা নতুন প্রকল্প, সামগ্রী ক্রয় অথবা প্রসারের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে এবং আয়ের অভাবে সময়মতো অর্থ পরিশোধ করতে পারে না।
হোম লোন
গৃহায়ন ঋণ খেলাপি পূর্বধারিত ঋণের একটি শ্রেণী যেখানে ব্যক্তিরা বা পরিবারগুলি নতুন বাড়ি ক্রয় করার জন্য অর্থ ঋণ করে এবং পরিশোধ অসম্ভব হলে খেলাপি হয়ে যায়। এসব মামলায়, অস্থির আর্থিক পরিস্থিতি প্রায়শই খেলাপি ঋণের কারণ হয়ে থাকে।
খেলাপি ঋণের কারণ
খেলাপি ঋণের পেছনে মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা কিছু স্পষ্ট প্যাটার্ন দেখতে পাই, যা অর্থনীতি, ঋণগ্রাহকের ব্যবস্থাপনা এবং ঋণের অনিয়মিত পরিশোধের সাথে সম্পর্কিত।
অর্থনীতির সংকট
অর্থনীতির সংকট হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে মার্কেটে সাধারণ ধীরগতির পরিস্থিতি বিরাজ করে, যা ব্যবসা ও ব্যক্তিগত আয়ে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। এটি ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা হ্রাস করে এবং খেলাপি ঋণের প্রবণতা বৃদ্ধি করে।
ঋণগ্রাহকের ব্যবস্থাপনা
অনেক সময় ঋণগ্রাহকেরা তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা যথাযথ ভাবে করতে পারে না, যার ফলে তারা ঋণের অনিয়মিত পরিশোধে ব্যর্থ হয়। এটি তাদের ক্রেডিট স্কোরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং অবশেষে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়।
ঋণের অনিয়মিত পরিশোধ
আর্থিক অনিশ্চয়তা, অপর্যাপ্ত আয় বা অপ্রত্যাশিত ব্যয় সহ নানা কারণে ঋণগ্রাহকেরা ঋণের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে অসমর্থ হন। এই ধরনের অনিয়মিত পরিশোধ খেলাপি ঋণের প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে।
সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অর্থনীতির সংকট ও ঋণগ্রাহকের অব্যবস্থাপনা একই সঙ্গে ঋণের অনিয়মিত পরিশোধের সমস্যাকে জটিল করে তোলে। এ কারণে খেলাপি ঋণের হার বাড়তে থাকে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
খেলাপি ঋণের প্রভাব
খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের স্থায়িত্বে গভীর প্রভাব ফেলে থাকে। এই প্রভাব কেবল ব্যাংকের আর্থিক কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর ব্যাপকতা অর্থনীতি ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে পরিলক্ষিত হয়।
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রভাব
খেলাপি ঋণের ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফা হ্রাস পায় এবং এর ফলে ব্যাংকিং খাতের স্থায়িত্বে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠে আসে। এছাড়া, ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনর্নির্ধারণের সামর্থ্য কমে যায়, যা ব্যাংকগুলোকে নতুন ঋণ বিতরণে সতর্ক করে তোলে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাধা
খেলাপি ঋণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বাধা সৃষ্টি করে। ঋণ প্রাপ্তির কঠিন হওয়ার ফলে নতুন ব্যবসা ও প্রকল্প শুরু হতে পারে না। এই বাধাগুলি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে স্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলে।
সমাজে প্রভাব
সামাজিক প্রভাব হিসেবে, খেলাপি ঋণ দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক অসমতা বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে, যারা সুবিধাভোগী নন, তারা এই অসমতার শিকার হন। এতে করে সামাজিক সংহতি বিঘ্নিত হতে পারে এবং সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়।
সামগ্রিকভাবে, খেলাপি ঋণের প্রভাব ব্যাংকিং খাতের স্থায়িত্ব, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বাধা এবং সামাজিক প্রভাবের মাধ্যমে স্পষ্ট। এর ফলে ব্যাংক, অর্থনৈতিক সংস্থা এবং সমাজের মধ্যে একটি টেকসই ও স্থিতিশীল পরিবেশ সুনিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি পায়।
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের উপায়
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এর নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর কৌশল আরোপ অপরিহার্য। ঋণ ব্যবস্থাপনা, ঋণ পুনঃস্কেলিং, এবং আইনগত পদক্ষেপ এই প্রক্রিয়ার মূল ধারা।
ঋণ ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া
ঋণ ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া এমন এক সংগঠিত পদ্ধতি যেখানে ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংকের মধ্যে একটি সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এখানে ঋণের পরিশোধ সময়সূচী, অর্থের ব্যবহার, এবং জরুরি পরিস্থিতিতে নতুন কৌশল গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা এবং নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত হয়।
ঋণ পুনঃস্কেলিং
ঋণ পুনঃস্কেলিং বা পুনর্গঠন হল ঋণের মেয়াদ ও সুদের হারে পরিবর্তন আনার একটি পদ্ধতি। এর মাধ্যমে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব হতে পারে, যাতে ঋণগ্রহীতা তার আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ করতে পারে। এতে ব্যাংকের সাথে সম্পর্কও সুস্থির থাকে।
আইনগত ব্যবস্থা
আইনগত পদক্ষেপ বিষয়গুলি ঋণ আদায়ের একটি মৌলিক উপায় হিসেবে কাজ করে। এতে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, যাতে তারা ঋণের পরিমাণ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় এই পদ্ধতি ব্যাংক ও অর্থনীতির জন্য দ্রুত সমাধান বের করে দিতে পারে।
খেলাপি ঋণের প্রতিকার
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত দেড় বছরে এক লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই বিবরণীকে প্রেক্ষিত রেখে, ঋণ পরিশোধের কৌশল এবং ঋণ আদায়ের পদ্ধতি গুলির প্রয়োগ এখন সমসাময়িক প্রয়োজন।
ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনা
ব্যাংক এবং ঋণগ্রহীতা একটি সুসময়োচিত ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনা তৈরি করে, যা সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য হতে পারে। এতে করে, প্রতি মাসের শেষে যাতে করে ঋণের ১০% পরিশোধ করা সম্ভব হয় তার একটি কাঠামো রচনা করা হয়।
দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া
ঋণগ্রহীতা যদি দেউলিয়া ঘোষণা করে, তবে তা একটি আইনগত প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য হয়, যেখানে তিনি তার আর্থিক অপারগতা জানান দেয়। এই প্রক্রিয়া ঋণগ্রহীতাকে অন্যান্য আইনগত আশ্রয় খোঁজার সুযোগ করে দেয়।
ঋণের পরিশোধের পরিকল্পনা এবং দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়ায় সুপরিচিত ও চালু পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে, ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংক উভয়ের জন্যই একটি প্রায়োজনীয় সমাধান তৈরি হতে পারে। এটি একজন ঋণগ্রহীতাকে তার আর্থিক দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে এবং ব্যাংককে তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরে পেতে সহায়তা করে।
খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ‘খেলাপি ঋণ’ হিসেবে চিহ্নিত অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ দেড় বছরেরও বেশি সময়ে ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত, খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা আগের ৯ মাসের তুলনায় ১৪% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকার তুলনায় ৭.১% বেশি। সেপ্টেম্বর মাসে খারাপ ঋণের ঘটনা জুন মাসের তুলনায় ২০০% বেড়ে ৯৯,২০৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৭% টাকা ৯টি সরকারি ব্যাংকের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। ব্যাংক হিসাবে খারাপ ঋণের অনুপাত এখন ৮৯% পৌঁছেছে। ঋণের বিলম্বিত পরিশোধ এবং অমূলক ঋণের প্রবণতা উদ্বেগজনক। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়া ঋণগ্রহীতাদের সংখ্যা বাড়ছে, যা খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগামী প্রবণতাকে নির্দেশ করে।
ব্যাংকগুলির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, পরিচালনা বোর্ডের সদস্য নির্বাচনে কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ এবং নিয়োগের মাধ্যমে, পাশাপাশি তদারকির জন্য পৃথক কমিটি গঠনের বিষয়গুলো বিবেচনা করা। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালনায় উন্নতি সাধন করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, ঋণগ্রহীতার ব্যবসা ও আর্থিক সততা, অপারেশনের দক্ষতা ও পরিচালনা অনুশীলনকে কঠোরভাবে মূল্যায়ন করে। ঋণ পুনরুদ্ধারে একটি বড় বাধা হলো অব্যবস্থাপনার নিয়ম বাস্তবায়নে আইনি প্রক্রিয়ার বিলম্ব। উচ্চ আদালতে শুধুমাত্র ডিফল্ট ঋণের মামলা নিষ্পত্তির জন্য উৎসর্গিত বেঞ্চ স্থাপন করা খেলাপি ঋণের প্রসারণ হ্রাস করতে সহায়ক হতে পারে।