মাইগ্রেন কি?

মাইগ্রেন হল এক ধরনের নিউরোভাস্কুলার ডিজঅর্ডার যা বিভিন্ন পার্শ্বজনিত কারণে শুরু হয়ে মাথাব্যথার তীব্র একক পর্বে প্রকাশ পায়, এবং ব্যথার তীব্রতা ও ধরন ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হতে পারে। মাইগ্রেনে প্রায়শই মাথাব্যথার সঙ্গে স্নায়বিক উপসর্গ যেমন, দৃষ্টিশক্তির হ্রাস, ঝাপসা দেখা, বা বমি বমি ভাব নিয়ে আসে, এবং ব্যথা একপাশে শুরু হয়ে অনেক সময় মাথার অর্ধেক অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

পৃথিবীজুড়ে মাইগ্রেন স্বাস্থ্য সংকট এবং অর্থনৈতিক চাপের এক প্রধান কারণ। ইউরোপে মাইগ্রেনের চিকিৎসা বাবদ খরচ বৃদ্ধি পাওয়া সাথে উৎপাদন ক্ষমতার হ্রাস পাওয়ার ফলে বার্ষিক খরচ অনুমান করা হয়েছে প্রায় €২৭ বিলিয়ন। অপরদিকে, মাইগ্রেনজনিত ব্যথা ও উপসর্গের কারণে কাজের স্থানে অনুপস্থিতি ও কর্মদক্ষতার হ্রাস পরিলক্ষিত হয়, যা স্নায়বিক উপসর্গ হিসেবে গণ্য করা হয়, এবং এ কারণে প্রতি বছর অনুমানিক $১৭ বিলিয়ন ডলারের ব্যয় বহন করতে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। মাইগ্রেনের ব্যথা এবং মাথাব্যথা নিরাময়ের জন্য কার্যকর ঔষধ ‘ট্রিপটানস’ এর প্রয়োগ এর ব্যয় প্রায় সবচেয়ে বেশি।

মাইগ্রেনের সংজ্ঞা এবং ধারণা

মাইগ্রেন মূলত একটি নিউরোভাস্কুলার ডিজঅর্ডার যা ব্যাপকভাবে পরিচিত ও গবেষণাধীন। এর প্রাথমিক কারণ হলো কর্টিক্যাল স্প্রেডিং ডিপ্রেশন যা মস্তিষ্কের কোষগুলিতে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎচুম্বকীয় পরিবর্তন ঘটায় এবং সেরোটোনিনের মাত্রা পরিবর্তন করে।

মাইগ্রেন কি ধরনের মাথাব্যথা?

মাইগ্রেনের অভিজ্ঞতা অন্যান্য মাথাব্যথা থেকে পৃথক। এটি মাথার একপাশে প্রধানত তীব্র ও পালসেটিং ব্যথা হিসাবে পরিচিত, যা ঘন্টার পর ঘন্টা বা দিনের পর দিন স্থায়ী হতে পারে।

মাইগ্রেনের বিভিন্ন ধরণের প্রকারভেদ

  • ক্লাসিক মাইগ্রেন: এটি প্রায়শই অরা সহ ঘটে, যা দৃষ্টিশক্তি প্রভাবিত করে।
  • হেমিপ্লেজিক মাইগ্রেন: এই ধরণের মাইগ্রেনে মানুষ অস্থায়ী পক্ষাঘাতর অভিজ্ঞতা করে।
  • সাইলেন্ট মাইগ্রেন: তীব্র মাথাব্যথা ছাড়াই অরা দেখা দিতে পারে এই প্রকারে।
  • রেটিনাল মাইগ্রেন: এটি চোখের অস্বাভাবিকতায় পরিলক্ষিত হয়, যেমন দৃষ্টি হারানো বা চোখে ঝাপসা দেখা।
আরও পড়ুনঃ  নতুন চুল গজানোর উপায়

মাইগ্রেনের বৈশিষ্ট্যগুলি বোঝার মাধ্যমেই রোগীরা আরও সচেতনায় ও উপযুক্ত চিকিৎসা প্রাপ্তির দিকে অগ্রসর হতে পারে। তাই, এর প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য জানা গুরুত্বপূর্ণ।

মাইগ্রেনের লক্ষণ

মাইগ্রেনের প্রথম ধাপে, যা সাধারণ লক্ষণ নামে পরিচিত, প্রধানত মাঝারি থেকে তীব্র মাথাব্যথা দেখা দেয়, যা সাধারণত মাথার এক পাশে অনুভূত হয়। এই অবস্থায়, রোগীরা ঘন ঘন বমি বমি ভাব অনুভব করে থাকেন। মাইগ্রেন হলে দৃষ্টিভ্রম এর সমস্যাও বিশেষ করে লক্ষ করা যায়, যেমন চোখের সামনে আলোর ঝলকানি বা অদৃশ্য রেখা দেখা।

সাধারণ লক্ষণ

  • মাথাব্যথা: এই ব্যথা সাধারণত মাথার একপাশে মাঝারি থেকে তীব্র হয়ে থাকে।
  • দৃষ্টিভ্রম: রোগীরা অস্পষ্ট দেখতে পারে অথবা তাদের চোখের সামনে ঝলকানি মনে হতে পারে।
  • বমি বমি ভাব: মাইগ্রেনের সময় পেট খারাপ এবং বমির প্রবণতা বাড়ে।

গুরুতর লক্ষণ

  • ঝনঝনে ভাব: মাথাব্যথা সহ হাত, পা অথবা মুখের একাংশে ঝনঝনে অনুভূতি।
  • অসাড়তা: কিছু ক্ষেত্রে রোগীরা অঙ্গ অসাড় হয়ে যাওয়ার অনুভূতি বর্ণনা করেন।
  • বিভ্রান্তি ও কথা বলার অসুবিধা: মাইগ্রেনের সময়ে চিন্তা করা ও স্পষ্টভাবে কথা বলা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • আলো ও শব্দের প্রতি শক্তিশালী সংবেদনশীলতা: আলো ও শব্দের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা বাড়ে, যার ফলে সাধারণ আলো বা শব্দও অসহনীয় মনে হয়।

মাইগ্রেনের কারণ

মাইগ্রেনের প্রবণতা বিভিন্ন কারণের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়, যা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি ভিন্ন হতে পারে। মূলত এই প্রবণতার পিছনে রয়েছে জেনেটিক কারণসমূহ, পরিবেশগত ট্রিগার এবং জীবনযাপনের বিভিন্ন দিক।

জিনগত কারণ

জেনেটিক গবেষণা দেখিয়েছে যে মাইগ্রেনের প্রবণতা পারিবারিক ইতিহাসের মাধ্যমে বংশগতিভাবে চলে আসে। প্রায় ৫০% মাইগ্রেন আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবারের কারও না কারও মাইগ্রেনের ইতিহাস থাকা স্বাভাবিক।

পরিবেশগত কারণ

পরিবেশগত ট্রিগার হিসেবে চকলেট, আঙুরের রস, অতিরিক্ত পনির, শব্দ ও আলোর পরিবর্তনগুলি প্রধান। এছাড়াও অতিরিক্ত স্ট্রেস, উজ্জ্বল ঝলকানি এবং ক্যাফিেন মাইগ্রেন ট্রিগার করতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  তলপেটে ব্যথা কিসের লক্ষণ?

জীবনযাপনের প্রভাব

জীবনযাপনের নানান দিক যেমন দৈনিক চাপ, অনিদ্রা, পর্যাপ্ত না খাওয়া বা অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস মাইগ্রেনের প্রবণতা সৃষ্টি করে। যৌন কার্যকলাপ বা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমও কখনও কখনও মাইগ্রেনের ক্রিয়াকারক হতে পারে।

সমগ্রভাবে, মাইগ্রেনের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আরও গবেষণা এবং সচেতনতার দরকার রয়েছে যাতে আক্রান্তরা উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে এই ব্যাধির প্রকোপ কমাতে পারে এবং একটি সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে।

মাইগ্রেনের চিকিৎসা

মাইগ্রেনের চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের অপশন নির্বাচন করা হয়। চিকিৎসার মান নির্ধারণে বিশেষ গুরুত্ব পায় রোগীর লক্ষণগুলির গভীরতা এবং মাইগ্রেনের ধরন।

চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি

মাইগ্রেন চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিছু প্রচলিত পদ্ধতি হলো:

  • ফার্মাকোলজিকাল ট্রিটমেন্ট: এতে ট্রিপটন যুক্ত ওষুধ প্রধান।
  • বিহেভিওরাল থেরাপি: স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ও রিলাক্সেশন টেকনিক অনুশীলন।
  • ডায়েট মডিফিকেশন: মাইগ্রেন ট্রিগার খাদ্য এড়িয়ে চলা।
  • যোগ ও মেডিটেশন: শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধি।

ওষুধের ভূমিকা

মাইগ্রেনের চিকিৎসায় ওষুধের ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে, ট্রিপটন যুক্ত ওষুধ ব্যাথা ও অন্যান্য সমস্যা হ্রাসে কার্যকর। গুরুতর ক্ষেত্রে সুমাট্রিপটান বা এরগটামিনের মতো শক্তিশালী ওষুধ প্রয়োজন পড়তে পারে। রোগীদের চিকিৎসা 6 মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত চলতে পারে, উপসর্গ অনুযায়ী ডোজ এডজাস্ট করা হয়।

  1. সুমাট্রিপটান: এর মাধ্যমে রক্তনালী সঙ্কুচিত হয়, যা মাইগ্রেন পেইন হ্রাস করে।
  2. অ্যামিট্রিপ্টিলিন : এটি মূলত অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট হিসেবে কাজ করে, তবে মাইগ্রেন প্রতিরোধে সহায়তা করে।
  3. মেটোক্লোপ্রামাইড: বমি বমি ভাব নিরাময়ে সহায়তা করে।

মাইগ্রেনের চিকিৎসা সঠিকভাবে নির্বাচন ও ব্যবহার করলে রোগীর জীবনমান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়। তবে, ওষুধের পাশাপাশি জীবনযাত্রায় পরিবর্তন ও সচেতনতা বৃদ্ধির গুরুত্ব অপরিসীম।

মাইগ্রেনের উপশম

মাইগ্রেন একটি জটিল মাথাব্যথা যা বিশ্বের অনেক মানুষকে প্রভাবিত করে। মাইগ্রেনের উপশমে সাহায্য করার জন্য, প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। নির্দিষ্ট ধরনের চিকিৎসা ও জীবনযাপন পদ্ধতি মাইগ্রেন রোগের উপসর্গ প্রশমনে সাহায্য করে।

আরও পড়ুনঃ  কেভিটি আছে কিনা জানার উপায়

প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি

বিভিন্ন প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা, হোমিওপ্যাথিক থেরাপি, মেডিটেশন এবং যোগাসন মাইগ্রেনের উপশমে অত্যন্ত কার্যকর। গবেষণা মতে, যোগ বা ধ্যান নিয়মিত অনুশীলন মাইগ্রেন রোগীদের মন ও শরীরকে শান্ত করে, যা হরমোনাল ভারসাম্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও, ল্যাভেন্ডার ও পিপারমিন্ট তেল ব্যবহারের মাধ্যমে অ্রোম্যাথেরাপিও উল্লেখযোগ্যভাবে মাইগ্রেনের যন্ত্রণা ও ঘনঘনতা কমাতে সহায়ক।

জীবনযাত্রার পরিবর্তন

মাইগ্রেনের প্রতিরোধে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন অপরিহার্য। নিয়মিত ঘুমের অভ্যাস, সুস্থ ডায়েট, এবং নিয়মিত ব্যায়াম একজন ব্যক্তির শরীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা মাইগ্রেন উপসর্গকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। উল্লেখযোগ্য হল, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট, 7 ঘন্টার উপযুক্ত ঘুম এবং স্টিমুল্যান্ট যেমন ক্যাফেইনের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া, মাইগ্রেনের প্রভাব কমাতে পারে। এছাড়াও, ট্রিগার খাদ্যগুলি, যেমন চকোলেট, চিজ এবং মদ্যপান এড়িয়ে চলা উচিত।

মাইগ্রেন সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা

মাইগ্রেন সম্পর্কিত তথ্য ও জ্ঞানের অভাবে নানান ভ্রান্তি চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যে মাইগ্রেন অর্থাৎ গুরুতর রোগ যা অতিশয় বেদনাদায়ক এবং খুবই কঠিন। যদিও মাইগ্রেন গুরুতরভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, তবে এটি সর্বদা কঠিন রোগের দিকে নিয়ে যায় না। উপযুক্ত চিকিৎসা এবং জীবনশৈলীতে পরিবর্তন আনলে মাইগ্রেন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

ভুল ধারণা ১: মাইগ্রেন সর্বদা গুরুতর

বিজ্ঞান জানায়, মাইগ্রেন আক্রান্তের তীব্রতা ব্যক্তি অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। চিকিৎসার পদ্ধতি এবং জীবনযাত্রা, যেমন পর্যাপ্ত ঘুম, সময়মতো খাওয়া এবং মানসিক চাপ কমানো মাইগ্রেনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক। তাই ধারণা যে প্রতিটি মাইগ্রেনই প্রচন্ড বেদনাদায়ক নয়।

ভুল ধারণা ২: মাইগ্রেন কেবল মাথাব্যথা

মাইগ্রেন কেবল মাথাব্যথা নয়, বরং এটি একটি স্নায়ুরোগ যার লক্ষণের ভিতর মাথাব্যাথার পাশাপাশি দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া, আলো ও শব্দে অনুভূতির পরিবর্তন, বমি বমি ভাব ইত্যাদি শামিল আছে। মাথার পেশীতে চাপের কারণে হওয়া মাইগ্রেন সমস্যা অনেকে গুরুত্ব দেন না এবং অনেক সময় ভুল চিকিৎসাও নেন। সত্যিকারের মাইগ্রেনের প্রতি সচেতনতা এই ভ্রান্তিগুলি দূর করতে পারে।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button