পিত্তথলির পাথর কেন হয়

পিত্তথলির পাথর বা গলস্টোনস হলো মানুষের পিত্তাশয়ে জমা হওয়া কিছু নিঃসৃত উপাদানের দৃঢ় কণা, যা পিত্তপাথর নামেও পরিচিত। মেডিকেল শাস্ত্রে কোলেলিথিয়াসিস নামে এই অবস্থাটি পেশা সংশ্লিষ্টদের কাছে জানা। উন্নত বিশ্বের প্রাপ্তবয়স্ক আবাদির প্রায় ১০-২০% এই পিত্তপাথরের সমস্যায় ভুগে থাকে এবং আমেরিকায় এর প্রভাবিত জনসংখ্যা প্রায় ২০ মিলিয়নের কাছাকাছি।

পিত্তাশয়ের রোগ জীবনযাপনে বাঁধা ও অসুবিধা সৃষ্টি করে যা বিশেষ করে পাথরের আকার এবং প্রকৃতি অনুসারে হতে পারে। বিশ্বব্যাপী, প্রায় ৯০% গলস্টোন কোলেস্টেরল দিয়ে গঠিত, এছাড়াও পিগমেন্ট এবং মিশ্রিত ধরনের পাথরও পাওয়া যায়। পিত্তথলির পাথরের কারণগুলো হিসেবে স্থূলকায় হওয়া, উচ্চ-চর্বিযুক্ত খাদ্য, ডায়াবেটিস, যকৃত রোগ এবং বারবার গর্ভধারণ ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এমন ঝুঁকির মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের জন্য, অ্যাপোলো হাসপাতালের মতো স্থাপনায় উপলব্ধ উচ্চ-মানের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি চিকিত্সা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

পিত্তথলির পাথরের পরিচিতি

পিত্তথলি অবস্থানপিত্তরস সংগ্রহস্থান জানার মাধ্যমে হজমের সাহায্য পাওয়া যায়। মূলত পিত্তরস মানবদেহের হজম প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে। এই পাথরের উৎপত্তি ও প্রকার বুঝতে হলে, পিত্তথলির কাঠামো ও কাজ সম্পর্কে জানা জরুরি।

পিত্তথলির ভূমিকা

পিত্তথলি মানবদেহের পাচন তন্ত্রের একটি মূল অংশ হিসেবে কাজ করে। এটি যখন পিত্তরস নিঃসরণ করে, তখন তা হজমের প্রক্রিয়াকে সুচারু রাখতে সাহায্য করে। ফলে, চর্বিযুক্ত খাবার সহজে ভাঙ্গা ও শোষিত হয়।

পাথরের প্রকারভেদ

পিত্তথলির পাথরের মূলত দুই ধরনের প্রকার রয়েছে – কোলেস্টেরল পাথর ও পিগমেন্ট পাথর। কোলেস্টেরল পাথর বেশি পরিচিত এবং বিশ্বের ৯০% পাথর এই ধরনের হয়। অপরদিকে, পিগমেন্ট পাথর মূলত বিলিরুবিন ক্যালসিয়াম লবণ, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, ক্যালসিয়াম ফসফেট, ক্যালসিয়াম পালমিটেট দ্বারা গঠিত হয়, যা কালো বা বাদামি রঙের হতে পারে।

  • কোলেস্টেরল পাথর: এসব পাথর সাধারণত মোমোর মতো নরম এবং হালকা হয়, যা চিত্রগ্রহণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
  • পিগমেন্ট পাথর: এই পাথরগুলি আকারে ছোট এবং ঘন হয়ে থাকে, এবং এক্স-রেতে সাধারণত সাদা দেখায়।
আরও পড়ুনঃ  ছারপোকা কামড়ালে কি হয়?

তাই, পিত্থথলির পাথর প্রকার নির্ধারণ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও চিকিৎসা পদ্ধতি চিন্তাভাবনায় অন্যতম মুখ৷

পিত্তথলির পাথর তৈরি হওয়ার কারণ

পিত্তথলির পাথরের সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি জটিল। একে ঋূঝানো যায় পিত্তথলির রোগ হিসাবে যার মুখ্য নির্দেশক হলো কোলেস্টেরল পাথর এবং বিলিরুবিন পাথরের উৎপত্তি।

কোলেস্টেরলের অতিরিক্ত পরিমাণ

পিত্তথলিতে কোলেস্টেরলের অতিরিক্ত পরিমাণ জমা হলে, কোলেস্টেরল পাথরের সৃষ্টি হয়, এটি হচ্ছে পিত্তথলির পাথরের রোগের একটি প্রধান ফার্ম। উন্নত বিশ্বে এই ধরনের পাথর সাধারণত দেখা যায়, যা প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে কোলেস্টেরল জনিত।

বিলিরুবিনের ব্যাপার

অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিলিরুবিন পাথরের সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে এশিয়া ও উপমহাদেশে। বিলিরুবিন, এক ধরনের উপাদান যা রক্তের লোহিত কণিকার বিপাক জাতীয় ক্রিয়াকলাপে নি:সৃত হয়, এর অতিরিক্ত পরিমাণ পিত্তথলিতে জমা হলে পাথরের সৃষ্টি ঘটাতে পারে।

কোন কারণগুলো ঝুঁকি বাড়ায়

পিত্তথলির পাথরের ঝুঁকি বাড়ানোর জন্য কিছু প্রধান কারণ রয়েছে যা আমাদের জীবনযাত্রা এবং পারিবারিক ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত হয়। নিচে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

জেনেটিক প্রভাব

পারিবারিক ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ যা পিত্তথলির পাথরের প্রবণতা বাড়াতে পারে। যদি কারো পরিবারের অন্য সদস্যের এই সমস্যা হয়ে থাকে, তবে তাঁরও এই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই জিনগত প্রবণতায় প্রভাবিত হতে পারে যেসব ব্যক্তিরাও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করে থাকেন।

জীবনযাপন ও খাদ্য অভ্যাস

  • অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা পিত্তথলির পাথর সৃষ্টির একটি বড় কারণ। বাড়তি ওজনের কারণে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে, যা পিত্তথলিতে পাথর সৃষ্টি করতে পারে।
  • খাদ্যাভ্যাসও একটি বড় ভূমিকা রাখে। উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার এবং কম ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া পিত্তথলির পাথরের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
  • শারীরিক অনুশীলনের অভাব এবং স্থির জীবনযাত্রা পিত্তথলিতে পাথর সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়ায়।

এই কারণগুলির সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা পিত্তথলির পাথর সৃষ্টির ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়ক হতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  মাসল স্ট্রেন রিকভারি দ্রুত করার উপায়

লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ

পিত্তথলির পাথর সাধারণত নীরবে থাকতে পারে, কিন্তু যখন এর লক্ষণ প্রকাশ পায়, তখন তা বেশ তীব্র হয়। পিত্তথলির শূলপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা রাখা জরুরি, যাতে সময়মতো চিকিত্সা নেওয়া যায়।

পেটের ব্যথা

পিত্তথলির পাথর যদি পিত্তনালীর মুখে চলে আসে, তাহলে তীব্র পেটের ব্যথা হতে পারে, যা প্রায়শই পেটের উপরের ডান দিকে অনুভূত হয়। এই ধরনের ব্যথা হঠাৎ হঠাৎ উপস্থিত হয় এবং ঘন্টার পর ঘন্টা স্থায়ী হতে পারে।

হজমের সমস্যা

পিত্তথলির পাথর যখন পিত্তথলির কাজে ব্যাঘাত ঘটায়, তখন হজমের প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে। এতে হজমে বিসমস্যা দেখা দেয়, যা অনেক সময় খাবার পর অস্বস্তি এবং পেট ফাঁপা হিসেবে প্রকাশ পায়।

এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে, অবিলম্বে চিকিত্সা নেওয়া উচিত যাতে করে গুরুতর জটিলতা এড়ানো যায়। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং নিয়মিত পরীক্ষা এসব জটিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে।

নির্ণয় প্রক্রিয়া

পিত্তথলির পাথর শনাক্তকরণের শুরুতে মেডিক্যাল পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। এই পরীক্ষা প্রথম ধাপে রোগীর ক্লিনিকাল উপসর্গ ও লক্ষণাবলি পর্যালোচনা করে, যা ডায়াগনস্টিক পদ্ধতির ভিত্তি তৈরি করে।

মেডিক্যাল পরীক্ষা

মেডিক্যাল পরীক্ষা পিত্তথলির পাথর শনাক্তকরণে একটি মৌলিক পর্যায়। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক একজন রোগীর ব্যথার অবস্থান, তীব্রতা, এবং অন্যান্য সংক্রান্ত লক্ষণ বিবেচনা করেন।

আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা

আলট্রাসনোগ্রাফি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে পিত্তথলির পাথরের আকার, পাথরের মাপ ও সংখ্যা নির্ধারণে। এই পরীক্ষা পিত্তথলি এবং চারপাশের কাঠামোগুলির দৃশ্যমান চিত্র প্রদান করে, যা নির্ণয় করতে সাহায্য করে।

  • পাথরের সংখ্যা এবং আকার নির্ণয়।
  • পাথরের ধরণ বোঝা।
  • পাথরের অবস্থান সনাক্ত করা।

যদিও এই পরীক্ষা অত্যন্ত কার্যকর, তবুও এর সাহায্যে সব ধরণের পাথর চিহ্নিত করা সবসময় সম্ভব হয় না। বড় বা অস্বাভাবিক জায়গায় অবস্থিত পাথরগুলি চিকিৎসকদের কাছে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। তাই, পর্যাপ্ত ডায়াগনস্টিক মূল্যায়নের জন্য প্রায়শই অতিরিক্ত পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়।

  1. কম্পিউটেড টমোগ্রাফি (CT) স্ক্যান।
  2. ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স চোলাঙ্গিওপ্যানক্রিটোগ্রাফি (MRCP)।
  3. এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড চোলাঙ্গিও-পানক্রিয়াটোগ্রাফি (ERCP)।

চিকিত্সার পদ্ধতি

পিত্তথলির পাথর চিকিত্সা বিভিন্ন ধরনের মাধ্যমে করা সম্ভব, যার মধ্যে ওষুধের মাধ্যমে এবং সার্জিক্যাল পদ্ধতি অন্যতম।

আরও পড়ুনঃ  দ্রুত ব্রংকাইটিস সারানোর উপায়

ওষুধের মাধ্যমে চিকিত্সা

নন-সার্জিক্যাল পদ্ধতি যেমনটি পিত্তথলির পাথর চিকিত্সায় প্রযোজ্য, এটি বিশেষ করে ছোট এবং ক্ষুদ্র পাথরের জন্য কার্যকর। এই পদ্ধতিতে ঔষধ ব্যবহার করা হয়, যা পাথরগুলিকে ধীরে ধীরে গলিয়ে দেয়।

সার্জিক্যাল বিকল্প

বড় পাথর অথবা যেখানে ঔষধের চিকিত্সা কার্যকর হয় না, সেখানে সার্জিক্যাল পদ্ধতি নেওয়া হয়। ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি, যা কম ব্যথা ও দ্রুত পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করে। এই পদ্ধতিটি অতি মৃদু কাটাকাটি সহ্য করে, যা শরীরে খুবই সামান্য ক্ষত তৈরি করে এবং সেফটি ও সাক্ষেস রেট খুবই উচ্চ।

  • কম সময়ে পুনরুদ্ধার
  • নিম্ন জটিলতার হার
  • পোস্ট-অপারেটিভ ব্যথা কম

উপরোক্ত তথ্য মাথায় রেখে, পাথরের ধরন এবং রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের বিবেচনায় চিকিত্সার যথাযথ পদ্ধতি নির্বাচন করা উচিত।

প্রতিরোধের উপায়

পিত্তথলির পাথর একটি সাধারণ স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যা প্রধানত ডায়েট এবং জীবনশৈলীর অভ্যাসের উপর নির্ভর করে। সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচুর মানুষের এই সমস্যা দেখা যায় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর প্রবণতা আরও বাড়ে। তবে কিছু সহজ পদক্ষেপ নিয়ে এর প্রবণতা এবং ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।

স্বাস্থ্যকর খাদ্য নির্বাচন

প্রধানত, একটি ডায়াটারি ব্যবস্থা যা উচ্চ ফাইবার এবং কম চর্বি যুক্ত খাবার গ্রহণ করে সেটি পিত্তথলি সম্পর্কিত সমস্যার প্রতিরোধে সাহায্য করে। ফল, সবজি, সম্পূর্ণ শস্য, এবং লিন প্রোটিন যেমন মুরগির মাংস ও মাছের মতো খাবারগুলি রেজিমেনে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

নিয়মিত ব্যায়াম

অন্যদিকে, ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিও প্রতিরোধে অনেক বড় ভূমিকা বহন করে। নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সহ পিত্তথলির পাথর সৃষ্টির পূর্বাভাস হ্রাস করে। চলমান জীবনযাপনের অভ্যাস এবং শরীরচর্চার মাধ্যমে এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হয়ে উঠে।

সমগ্র স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পরিকল্পনায় পিত্তথলির পাথর প্রতিরোধের উপায় অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। চিকিৎসা শুরু করার পূর্বে একবার চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদ এর সাথে পরামর্শ করাও উচিত। এই পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে মান্য করা হলে, পিত্তথলির পাথরে জর্জরিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে এবং একটি স্বাস্থ্যকর দীর্ঘ জীবন যাপন করা সম্ভব হবে।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button