কোমরের বাম পাশে ব্যথা কেন হয়?

অনেকের কোমর ব্যথা একটি প্রচলিত সমস্যার নাম যা কখনো কখনো উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। এ সমস্যা বয়সভেদে প্রায় ৮০% মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পায়, বিশেষ করে তিরিশ বছর বয়স থেকে। কোমরে বাম পাশে ব্যথা ঘটার কারণগুলো বহুমুখী হতে পারে এবং এই ব্যথার চিকিৎসার জন্য ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত চলাফেরার ভঙ্গি, শারীরিক ব্যায়াম, এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শুধুমাত্র ব্যথার বিষয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে, ব্যথার কারণ এবং এর সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকি সম্পর্কেও সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কোমরের বাম পাশে ব্যথার কারণ বুঝতে গেলে, আমাদের পেশীর দুর্বলতার পাশাপাশি অধিক ওজন, আসন সংক্রান্ত সমস্যা, মেরুদণ্ডের বিকল্প অবস্থা, হরমোনাল পরিবর্তন, এবং কিছু নির্দিষ্ট রোগ বা শর্ত সমূহের বিষয়েও মনোযোগ দেওয়া উচিত। আসুন, আমরা এই ব্যথাকে আমাদের জীবনের এক অংশ না বানিয়ে এর মূল কারণগুলিকে জানি এবং তারপর সঠিক কোমর ব্যথার চিকিৎসা গ্রহণ করি।

কোমরের বাম পাশে ব্যথার সাধারণ কারণ

কোমরের বাম পাশে ব্যথা প্রধানত বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমস্যা এবং মেরুদণ্ড সমস্যা থেকে উৎপন্ন হতে পারে। এই ধরনের ব্যথার মূল কারণগুলি বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পেশী টানি বা স্প্রেইন

গভীর পেশী টান অথবা পেশীগুলির স্প্রেইন সাধারণত হঠাৎ ভারী জিনিস তুলতে গিয়ে অথবা আকস্মিক শারীরিক নড়াচড়ায় ঘটে। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত বেদনাদায়ক এবং প্রদাহজনক হয়ে থাকে।

মেরুদণ্ডের সমস্যা

মেরুদণ্ডের সমস্যা যেমন হার্নিয়েটেড ডিস্ক, যা মেরুদণ্ডে পীড়ন এবং চাপের কারণে ঘটতে পারে, এটি সংলগ্ন স্নায়ুকে চাপ দিয়ে নিতম্ববেদনা এবং পায়ে ব্যথা সৃষ্টি করে। স্কোলিওসিস এর মতো মেরুদণ্ড সমস্যাও কোমরে ব্যথার একটি প্রধান কারণ।

আরও পড়ুনঃ  চিয়া সিড খেলে কি ওজন বাড়ে?

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমস্যা

কিডনি বা জরায়ু সংক্রান্ত সমস্যা যেমন কিডনির সমস্যা এবং জরায়ু সমস্যা মধ্যে কিডনি পাথর বা নানা ধরনের ইনফেকশনের কারণেও কোমরের বাম পাশের ব্যথা হতে পারে। এই ধরনের ব্যথা অনেক সময় তীব্র এবং ঠিক যেখানে সমস্যা হচ্ছে সেই স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে।

ব্যথার ধরন বুঝতে পারা

ব্যথা বিভিন্ন রকমের হতে পারে এবং এর ধরন সনাক্ত করা ব্যথার কারণ এবং চিকিৎসার উপযুক্ত পদ্ধতি নির্ধারণে সাহায্য করে। কোমরের বাম পাশে যে ব্যথা হয়, তা তীব্র কোমর ব্যথা, মৃদু কোমর ব্যথা অথবা ক্রনিক কোমর ব্যথা হতে পারে।

তীব্র ব্যথা

তীব্র ব্যথা হঠাৎ শুরু হয়ে তীব্রতায় খুব প্রকাশিত হয়। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত সাময়িক হয়ে থাকে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই উপশম পায়। দ্রুত শনাক্ত করে, উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করার দরকার হয়।

মৃদু ব্যথা

মৃদু ব্যথা হল সেই ধরনের ব্যথা, যা সহনীয় হয় এবং এটি কোমরের বাম পাশে মন্থর বেদনা হিসেবে প্রকাশ পায়। এই ব্যথা ক্রমাগত হতে পারে কিন্তু তীব্রতা কম। প্রায়ই ব্যথা সহনীয় মাত্রায় থাকে এবং নিয়মিত কাজে বিঘ্ন ঘটায় না।

স্থায়ী ব্যথা

স্থায়ী ব্যথা হল সেই ব্যথা যা বহু সপ্তাহ বা মাস ধরে স্থায়ী হয় এবং সাধারণত ক্রমাগত ব্যথা হিসাবে প্রকাশ পায়। এটি তীব্র ব্যথার অভিজ্ঞতার পরে হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে। এই ধরনের ব্যথা জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে এবং অবহেলা করা উচিত নয়।

বল প্রয়োগের প্রভাব

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শারীরিক শ্রম ও ব্যায়ামে কোমরের উপর প্রযোজ্য বলের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, ভারী উত্তোলন ও দৈনন্দিন কাজের তুলনা করলে দেখা যায়, নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক কার্যকলাপ যেমন ভার বহন করা বা বারবার বেঁকে যাওয়া এই ধরনের ব্যথার জন্য দায়ী।

আরও পড়ুনঃ  রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস স্থায়ী নিরাময়ের উপায়

দৈনন্দিন কাজের জন্য

  • দৈনন্দিন তুলনায় দেখা যায়, যাঁদের কাজ গুরুতর শারীরিক শ্রম জড়িত তাদের মধ্যে কোমরের ব্যথা সাধারণ।
  • ভারী বস্তু উত্তোলন দিনের অধিকাংশ সময়ে কোমরে চাপ সৃষ্টি করে যা ব্যথাকে উস্কে দেয়।

ব্যায়ামের সময়

  • ব্যায়াম প্রভাব অনেক সময়ে কোমরের পেশী ও হাড়ের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।
  • অনুশীলনে অসাবধানতা এবং অনুপযুক্ত পদ্ধতি কোমরের ব্যথার মূল কারণ হতে পারে।

এই বিষয়গুলির উপর নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ ও সচেতনতার মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবন ও ব্যায়ামের সময় কোমর ব্যথার প্রকোপ হ্রাস করা সম্ভব।

পেশী ও হাড়ের সমস্যাগুলি

কোমরের বাম পাশে ব্যথা অনেক সময় হাড় এবং পেশী সংক্রান্ত সমস্যা থেকে উদ্ভূত হয়। এসব সমস্যা কখনও কখনও সাধারণ হলেও গুরুতর রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এখানে আমরা দুটি প্রধান হাড় এবং পেশীর সমস্যা আলোচনা করব- অস্টিওপোরোসিস এবং পেশীর সংকোচন, যা ব্যথার উৎস হতে পারে।

হাড়ের রোগ

অস্টিওপোরোসিস হল একটি অবস্থা যেখানে হাড়গুলি দুর্বল এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, যা সহজেই ভাঙতে পারে। এই অবস্থা ব্যথা এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে মেরুদণ্ডের এলাকায়। এর পাশাপাশি, স্কোলিওসিস, যা একটি সাধারণ হাড়ের সমস্যা যা মেরুদণ্ডের বক্রতা সৃষ্টি করে, তাও কোমরের ব্যথার কারণ হতে পারে।

পেশী সংকোচন

পেশীর সংকোচন বা পেশীর স্পাজমগুলি প্রায়ই অতিরিক্ত ব্যবহার, আঘাত বা অপ্রীতিকর শারীরিক কসরতের ফলে ঘটে। এই ধরনের ব্যথা হঠাৎ হঠাৎ উপস্থিত হয় এবং তীব্র বেদনা সৃষ্টি করে। পেশীর সংকোচন সাধারণত বিশ্রাম এবং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হয়, কিন্তু পেশীতে দীর্ঘকালীন চাপ পড়লে এটি বারবার ঘটতে পারে।

এই ধরনের হাড় এবং পেশীর সমস্যাগুলি পরিচিতি এবং সঠিক চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসা সম্ভব। এক্ষেত্রে, নিয়মিত অনুসরণ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরী।

বাম দিকে ব্যথার অন্যান্য কারণ

বাম দিকে অস্বাভাবিক ব্যথা প্রায়ই বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। এই অবস্থাগুলোর মধ্যে ডায়াফ্রাগম ব্যথা এবং অন্ত্রের সমস্যা অন্যতম।

আরও পড়ুনঃ  মস্তিষ্কের ধোঁয়া দূর করার উপায়

ডায়াফ্রাগমের সমস্যা

ডায়াফ্রাগম, যা ফুসফুস ও পেটের মাঝে একটি পেশীর স্তর হিসেবে কাজ করে, যদি কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তা ডায়াফ্রাগম ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। এটি অক্সিজেনের চাহিদা ও রক্তচাপের সমন্বয় ব্যাহত করে, যা ব্যথা এবং অস্বস্তি ঘটায়।

অন্ত্রের সমস্যা

অন্ত্রের সমস্যা বিশেষ করে আলসারেটিভ কোলাইটিস এবং ক্রোন’স ডিজিজ, পেটের বাম দিকে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। এই দুই রোগের উপস্থিতি অন্ত্রের প্রদাহ ও অবরুদ্ধতা ঘটিয়ে, প্রচণ্ড ব্যথা এবং অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি করে।

  1. ডায়াফ্রাগম ব্যথা: প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করার ক্ষেত্রে।
  2. অন্ত্রের সমস্যা: পাকস্থলী ও অন্ত্রের সমস্যায় তীব্র ব্যথা।

এই সমস্যাগুলি ক্রমাগত মনিটরিং এবং যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যদি ব্যথা অব্যাহত থাকে বা বাড়তে থাকে, তাহলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময়

যখন কোমরের বাম পাশে ব্যথা সহনীয় না থাকে, অথবা ব্যাথা চিকিৎসা নিয়েও যখন ভালো হয় না, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ। ব্যথার অন্যান্য সঙ্কেত যেমন হৃদরোগের উপসর্গ এবং অন্যান্য উদ্বেগজনক লক্ষণ থাকলে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি।

কখন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি

যদি আপনি অত্যধিক ঘর্মাক্ত হন, অস্বাভাবিক দুর্বলতা অনুভব করেন, মাথা ঘোরা বা বমি বমি ভাব অনুভব করেন, এবং তার সাথে বুকের ব্যথা থাকে, তাহলে অবিলম্বে মেডিকেল স্ক্যান এবং নির্ণয় পদ্ধতির জন্য চিকিৎসকের শরনাপন্ন হওয়া উচিৎ। এগুলো হৃদরোগের লক্ষণ হতে পারে, যা অত্যন্ত গুরুতর ও জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

সাধারণ পরীক্ষা ও স্ক্যান

ব্যাথা চিকিৎসায়, চিকিৎসকরা প্রথমে সাধারণ শারীরিক পরীক্ষা করে থাকেন এবং তারপরে প্রয়োজনে এক্স-রে, MRI, অথবা CT স্ক্যানের মাধ্যমে আরও গভীর নিরীক্ষণ করেন। এই পরীক্ষাগুলো শরীরের অভ্যন্তরের সমস্যা যেমন মেরুদণ্ডের সমস্যা, অথবা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের সমস্যা অনুধাবন করতে সহায়তা করে। অতএব, শুধু ব্যথা নিবারণই নয়, ব্যথার আসল কারণ অনুসন্ধান এবং তা চিকিৎসা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button