এনাল ফিসার থেকে কি ক্যান্সার হয়?

এনাল ফিসার এবং মলদ্বার ক্যান্সার, দুটি আলাদা স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে। মলদ্বারে যন্ত্রণা এবং রক্তপাতের সাথে যুক্ত এনাল ফিসার নিজে থেকেই বিরক্তিকর হলেও, এর মধ্যে ক্যান্সার ঝুঁকি রয়েছে কিনা সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মলদ্বার ফিসারের সঠিক নির্ণয় এবং চিকিৎসা ক্যান্সারের জীবন-মারাত্মক হুমকি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে।

বিশেষজ্ঞগণের মতে, এনাল ফিসারের তীব্র ব্যথা সত্ত্বেও, এটি সরাসরি মলদ্বার ক্যান্সারের উৎপত্তির কারণ নয়। তবে, মলদ্বার ক্যান্সারের শতকরা ৬৫ ভাগ ক্ষেত্রে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) দ্বারা সংক্রমণের ঝুঁকি বিদ্যমান, এবং এই সংক্রমণ প্রতিরোধে সচেতনতা ও নির্ণয়ের মাধ্যমে ক্যান্সার ঠেকানো সম্ভব। এনাল ফিসার সাধারণত নিজ থেকেই নিরাময় হয়, কিন্তু সেই সাথে চিকিৎসা না হলে, জটিলতা যেমন মলদ্বারের ক্রনিক প্রদাহ বা অন্যান্য ক্যান্সার ঝুঁকি সাধারণীকরণ করতে পারে।

এনাল ফিসার কি?

এনাল ফিসার হলো মলদ্বারের এক ধরনের ফাটল বা চির যা বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। এই ফাটল থেকে মলত্যাগ কালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাথা ও রক্তপাত হতে পারে, যা প্রায়ই যেসব ব্যক্তিতে এনাল ফিসার দেখা দিতে পারে, তাদের পায়ুপথের সমস্যায় জড়িয়ে থাকে। এটি মূলত মলদ্বারের ক্ষতিজনিত সমস্যা, যা প্রথমিক ভাবে স্ট্রেনিং এবং কঠিন মলের কারণে সৃষ্টি হতে পারে।

এটির লক্ষণ ও উপসর্গ

  • মলত্যাগের সময় তীব্র ব্যথা ও প্রচণ্ড চুলকানি।
  • মল দেখার সাথে সাথে রক্তের দেখা মিলে।
  • দীর্ঘস্থায়ী অস্বস্তি, যা দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা দেয়।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য এবং প্রদাহের মতো অন্যান্য পায়ুপথের সমস্যা হতে পারে।

চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা

এনাল ফিসার চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। শুরুতে নিয়মিত গরম জলে স্নান এবং প্রচুর পানি পান করে কোষ্ঠকাঠিন্য এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। ফাইবারসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত যা মল নরম করে এবং মলত্যাগ সহজ করে। রোগীদের চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী পেইন রিলিফ যেমন আইবুপ্রোফেন বা প্যারাসিটামল গ্রহণ করা উচিত। কখনো কখনো, চিকিৎসক অপারেশনের পরামর্শ দিতে পারেন, যদি ফাটলটি গভীর হয় এবং দ্রুত সেরে না ওঠে।

আরও পড়ুনঃ  রক্তে SGPT বেড়ে গেলে কি হয়?

সময়মত চিকিৎসা না নিলে এনাল ফিসার খুব দ্রুত জটিল হয়ে উঠতে পারে, যা মানসিক ও শারীরিক দুর্ভোগের কারণ হয়। তাই, এনাল ফিসার লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।

ক্যান্সার কি?

ক্যান্সার হলো শরীরের কোষগুলির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিভাজন, যা শরীরের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এই অস্বাভাবিক কোষগুলো বিভিন্ন অঙ্গানুগ স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে এবং বিভিন্ন প্রকারের ক্লিনিকাল লক্ষণ নির্দেশ করে, যা ক্যান্সারের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।

ক্যান্সারের প্রকারভেদ

  • মলদ্বারের ক্যান্সার: এটি মলদ্বারের অভ্যন্তরীণ প্রাচীরের ম্যালিগন্যান্ট টিউমার যা নিম্নগুলির মধ্যে অন্যতম।
  • ব্রনক এবং স্তন ক্যান্সার: এগুলি আমাদের দেশে সবচেয়ে প্রচলিত ধরণের ক্যান্সার।
  • রক্তের ক্যান্সার: যেমন লিউকেমিয়া, যা রক্ত সৃষ্টিকারী টিস্যুতে অবস্থিত।

ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণ

ক্যান্সার বিভিন্ন প্রকারের হয় এবং প্রতিটির লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে। তবে নিম্নলিখিত কিছু সাধারণ লক্ষণ যা প্রায় শনাক্ত করা যায়ঃ

  • মলদ্বার ক্যান্সারের লক্ষণ: মলদ্বার থেকে অস্বাভাবিক রক্তপাত, প্রস্রাবে পরিবর্তন, ওজন হ্রাস পাওয়া।
  • অবিরাম ক্লান্তি ও দুর্বলতা: অবিরাম ক্লান্তি অনুভব করা যা বিশ্রাম নিলেও দূর হয় না।
  • ইনফেকশন এবং জ্বর যা সাধারণত প্রদাহজনিত রাক্তক্ষরণের ফলে হয়।

উপস্থাপিত এই তথ্যগুলির সাহায্যে ক্যান্সার চিনে নেয়া এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ। ক্যান্সারের প্রকারগুলি এবং লক্ষণ সম্পর্কিত সঠিক ধারণা থাকা সহায্য করে এর প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসায় সফলতা অর্জন করতে।

এনাল ফিসার এবং ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক

এনাল ফিসার এবং মলদ্বারের ক্যান্সার সম্পর্কিত গবেষণা পর্যালোচনা দেখায় যে, সরাসরি কোনো সংযোগ না থাকলেও, অপর্যাপ্ত চিকিৎসাযুক্ত এনাল ফিসার মলদ্বার ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। যথাযথ ও সঠিক সময়ে চিকিৎসা এই জটিলতা এড়ানোর এক অন্যতম উপায়।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা

বিস্তারিত গবেষণা এবং পরীক্ষানিরীক্ষায় দেখা যায়, এনাল ফিসার যদি দীর্ঘমেয়াদী হয় তবে মলদ্বারে অতিরিক্ত চাপ ও প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে ক্যান্সারের সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ায়। এই প্রদাহজনিত পরিবেশ ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রদান করে।

আরও পড়ুনঃ  কিডনিতে পাথর আছে কিনা বুঝবেন কীভাবে

চিকিৎসকবৃন্দের মতামত

স্বনামধন্য চিকিৎসকগণ মনে করেন যে যথাসময়ে এনাল ফিসারের সঠিক চিকিৎসা মলদ্বারের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। স্থানিক চিকিৎসার পাশাপাশি, প্রায়ই মলদ্বারের অপারেশন প্রয়োজন হয়ে পড়ে যা মলদ্বারের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং এভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো যায়। যথাযথ পুষ্টি এবং নিয়মিত পরীক্ষা নির্ণায়ক।

  • এনাল ফিসারের সঠিক চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
  • চিকিৎসার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব।

মলদ্বারের ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়াতে যথাসময়ে চিকিৎসা ও সঠিক জীবনযাপন অপরিহার্য।

এনাল ফিসারের কারণসমূহ

এনাল ফিসারের সমস্যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যার মধ্যে প্রধান হলো দৈনন্দিন অভ্যাস ও খাদ্যাভ্যাস। একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অবলম্বন করে এই সমস্যার প্রকোপ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

খাদ্যাভ্যাসের ভূমিকা

এনাল ফিসার কারণ হিসেবে খাদ্যাভ্যাস অন্যতম। যথেষ্ট ফাইবার যুক্ত খাবার এবং পর্যাপ্ত পানি পান না করলে মল কঠিন এবং বড় হয়ে গিয়ে এনাল ফিসার সৃষ্টি করতে পারে। ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার যেমন শাক-সবজি, ফলমূল এবং শস্য পণ্য নিয়মিত খাওয়া এবং প্রচুর পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জীবনশৈলীর প্রভাব

দৈনন্দিন অভ্যাস যেমন শারীরিক অনুশীলনের অভাব, দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা ইত্যাদি এনাল ফিসারের সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়াতে পারে। নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন, যেমন হাঁটা বা সাঁতার কাটা, পরিপাক তন্ত্রকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে এবং মলত্যাগ সহজ করে তোলে। এছাড়াও, নিয়মিত পরিমাণে ইসবগুলের ভুসি সেবন করা মলকে নরম করে এনাল ফিসার প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।

  • ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্যভ্যাস গ্রহণ।
  • প্রচুর পানি পান।
  • নিয়মিত শারীরিক চর্চা।
  • উপযুক্ত স্থায়ী এবং বসার অভ্যাস।

এনাল ফিসারের চিকিৎসা

এনাল ফিসার সমস্যায় ভুগলে তা থেকে উত্তীর্ণ হতে দুটি প্রধান পথ রয়েছে—ঘরোয়া চিকিৎসা এবং পেশাদার মেডিক্যাল সাহায্য। এই উপায়গুলি নির্ভর করে রোগীর এনাল ফিসারের গুরুত্ব এবং প্রকৃতি উপর।

বাসা থেকে যত্ন

প্রাথমিক পর্যায়ে, এনাল ফিসার প্রতিকারের জন্য ঘরোয়া চিকিৎসা খুবই কার্যকর। এগুলি সাধারণত ব্যথা এবং অস্বস্তি হ্রাস করে এবং ক্ষত স্থানে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

  • পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা
  • আঁশযুক্ত খাবার যেমন ফলমূল এবং সবজি খাওয়া
  • রেগুলার ব্যায়াম
  • গরম পানিতে বসে থাকা, যা পাইলস বাথ হিসেবে পরিচিত
আরও পড়ুনঃ  রক্তে ইনফেকশন কেন হয়?

পেশাদার চিকিৎসা

যদি ঘরোয়া চিকিৎসা দ্বারা সারা না যায়, তাহলে মেডিক্যাল সাহায্য নেওয়ার দরকার পড়ে। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরামর্শ প্রদান করবেন এবং প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়া বা শল্য চিকিৎসা সুপারিশ করবেন।

  • লেজার স্ফিঙ্কটোমি
  • ল্যাটারাল ইন্টারনাল স্ফিঙ্কেরটোমি (LIS)
  • নির্ধারিত ঔষধ প্রয়োগ

এনাল ফিসার প্রতিকারঘরোয়া চিকিৎসাগুলি প্রায়শই অস্থায়ী সমাধান হিসেবে কাজ করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী উপশম ও সারাতে যে কোনও মেডিক্যাল সাহায্য আবশ্যক।

ক্যান্সারের ঝুঁকি নির্ধারণ

ক্যান্সারের ঝুঁকি বুঝতে গেলে সর্বপ্রথম জানা দরকার কোন কোন রোগীদের জন্য এই ঝুঁকি বেশি। বিশেষত, যারা মলদ্বার ক্যান্সারের ঝুঁকি বহন করেন, তাদের মধ্যে এইচপিভি সংক্রমণইমিউনোকম্প্রোমাইজড অবস্থার রোগীরা প্রধান।

ঝুঁকিবহুল রোগী গ্রুপ

  • যারা ইমিউনোকম্প্রোমাইজড হয়ে পড়েছেন, তাদের শরীর সংক্রমণের প্রতি কম প্রতিরোধী হয়।
  • এইচপিভি সংক্রমণের ইতিহাস যুক্ত ব্যক্তি।
  • দীর্ঘমেয়াদি মলদ্বার অসুবিধা বা অন্যান্য যৌনসংক্রান্ত রোগের ইতিহাস যুক্ত রোগীদের।

ঝুঁকি মোকাবেলার উপায়

  1. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: নিয়মিত ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা অবশ্যই জরুরি। বিশেষ করে, এইচপিভি সংক্রমণের পরীক্ষা এবং ইমিউনোকম্প্রোমাইজড অবস্থা মনিটর করা।
  2. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: সুষম খাবার এবং নিয়মিত ব্যায়াম সহজাত রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
  3. যৌন স্বাস্থ্যে সচেতনতা: ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণ এড়িয়ে চলা এবং নিয়মিত যৌন স্বাস্থ্য পরীক্ষা গ্রহণ।

এই উপায়গুলি সঠিকভাবে অনুসরণ করলে মলদ্বার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

এনাল ফিসারের পরবর্তী স্বাস্থ্য পরীক্ষা

এনাল ফিসারের পরিবীক্ষণ ও নিরীক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। একবার চিকিৎসা পেলেও, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ যার দ্বারা কোনো উপসর্গের পুনরাবৃত্তি বা পায়ুপথ জটিলতা যেমন অন্যান্য সেপটিক অবস্থা এড়ানো সম্ভব হয়।

নিয়মিত পরীক্ষা কেন গুরুত্বপূর্ণ

আমাদের উচিত নিয়মিতভাবে চিকিৎসা নিরীক্ষণ ও নির্ণয় পদ্ধতির অংশ হিসেবে নির্দিষ্ট পরীক্ষাগুলি করানো। এই পরিচিতির মাধ্যমে চিকিৎসকরা পুনরাবৃত্তি বা অগ্রগতির সম্ভাবনার প্রতি সজাগ থাকতে পারেন, এবং তা সময়মতো চিকিৎসা প্রদানের চেষ্টা করতে পারেন।

কোন পরীক্ষা হবে?

পায়ুপথের সমস্যা এবং ফিসারের পরবর্তী অবস্থা পরীক্ষাকালে এন্ডোস্কপি, কোলোনস্কপি, অ্যানোস্কপি প্রভৃতি পরীক্ষাগুলির প্রতি বিশেষ জোর দেওয়া হয়, যা মলদ্বারের অভ্যন্তরের সঠিক ছবি তুলে আনতে এবং সমস্যার গভীরতা নির্ণয়ে সহায়ক হয়। সময় অনুযায়ী, প্রয়োজন মতো, অতিরিক্ত পরীক্ষার পরিকল্পনাও রাখা প্রয়োজনীয়।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button