কিশোর কুমার – বাংলা সংগীতের অমর কণ্ঠ

কিশোর কুমার, ভারতীয় সংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার গান আজও মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত। কিশোর কুমারের গান শুধুমাত্র শ্রুতিমধুর ছিল না, বরং এতে মিশে থাকত প্রাণের ছোঁয়া। ১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করা এই কিংবদন্তি শিল্পী ১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর আমাদের থেকে চিরবিদায় নেন। তবে বাংলা সংগীতের এবং ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে তার অবদান চির স্মরণীয়।

ভারতীয় সংগীত কিংবদন্তি কিশোর কুমার শুধুমাত্র প্লেব্যাক গায়ক হিসেবেই নয়, তিনি ছিলেন একজন গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং প্রযোজক। তার গাওয়া গান বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় জনপ্রিয়তা লাভ করে। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, আসামি, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরি, মালায়ালাম, ওড়িয়া এবং উর্দূ ভাষায় তার গান অত্যন্ত শ্রুতিসুখকর ছিল। তিনি আটবার ফিল্মফেয়ার সেরা পুরুষ প্লেব্যাক গায়কের পুরস্কার জিতেছেন, যা এখনো একটি রেকর্ড।

প্রারম্ভিক জীবন

কিশোর কুমার, ভারতীয় সংগীত জগতের এক অবিস্মরণীয় নাম, ১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট মধ্যপ্রদেশের খান্দোয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম ছিল আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। শৈশবে তিনি বাড়ির তৈরি পরিবেশে বড় হয়েছিলেন, যা তার সঙ্গীত জীবনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তার জন্ম আর শৈশবকাল নানা কাহিনীতে পরিপূর্ণ।

জন্ম ও শৈশব

কিশোর কুমার জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৪ আগস্ট ১৯২৯ সালে, ব্রিটিশ ভারতের মধ্যপ্রদেশের খান্দোয়ায়। তার শৈশব কাটে পরিবারের সাথে মৃদু বাঙালি পরিবেশে। ছোটবেলায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি সঙ্গীতের প্রতিও গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তার শৈশবে গান গাওয়ার ঝোক ছিল এবং সেই আগ্রহই একদিন তাকে ভারতীয় সংগীত জগতের শিরোমণিতে পরিণত করে।

আরও পড়ুনঃ  নন্দমুরি বলকৃষ্ণ

পরিবার

কিশোর কুমারের পরিবারে থাকা চারটি অদ্ভুত কাহিনী বরাবরই সবাইকে মোহিত করেছে। তিনি জীবনে চারবার বিয়ে করেছিলেন এবং কিন্তু সংসারে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই বিয়েগুলো বোঝার জন্য সবাই আগ্রহী থাকে। কিশোর কুমার শৈশব ও বড়বেলা নিয়ে তার পরিবারের বন্ধন খুবই দৃঢ় ছিল। তাদের পরিবার ছিল সৃজনশীলতায় ভরপুর, যা কিশোর কুমারের সংগীত প্রতিভাকে সপুষ্ট করেছিল। কিশোর কুমার পরিবার নিয়ে তার প্রকৃত অভিমান ছিল এবং তারা তার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছিল।

কর্মজীবনের শুরু

কিশোর কুমার, বাংলা সংগীতের অমর কণ্ঠের অধিকারী, কর্মজীবনের প্রথমদিকে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন। তবে তার প্রতিভা ও অভিন্ন নিষ্ঠা তাকে একটি বিশেষ স্থান দখল করিয়েছে।

প্রথম চলচ্চিত্র

কিশোর কুমারের প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘শিকারী’ যেখানে তার দাদা অশোক কুমারও অভিনয় করেছিলেন। এই চলচ্চিত্রটি তাকে চলচ্চিত্র জগতে পরিচিত করে তোলে এবং তার অভিনয়ের দক্ষতা প্রদর্শন করতে সহায়ক হয়।

প্রথম প্লেব্যাক গান

কিশোর কুমার প্লেব্যাক গান হিসেবে নিজের প্রতিভাকে প্রথম প্রকাশ করেন ‘জিদ্দি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, যা মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। এই গানের মাধ্যমেই শ্রোতারা তার অসাধারণ কণ্ঠের জাদু প্রথম অনুভব করেন। কিশোর কুমার প্লেব্যাক গান হিসেবে নিজের স্থান সুদৃঢ় করেন এবং পরবর্তীতে অসংখ্য হিট গান উপহার দিতে থাকেন।

বাংলা সংগীতের যুগান্তকারী অবদান

কিশোর কুমারের বাংলা সংগীতে অবদান অতুলনীয়। তার অসাধারণ কণ্ঠস্বর, সুরের মাধুর্য এবং সংগীতে পরিশ্রম তাকে বাংলা গানের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে। কিশোর কুমার বাংলা গান শুধুমাত্র গান হিসেবে নয়, বিজয়ের প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছে। তার গানগুলি আজও শ্রোতাদের মনে এক আলাদা স্থান ধরে রেখেছে।

কিশোর কুমারের গানের শৈলী ও কণ্ঠের প্রভাব বাংলায় এক নতুন ধারার সূচনা করে। তার গাওয়া ছায়াছবির গানগুলো যেমন ‘আন্ধি’, ‘মিলি’, ‘অনুরাগ’, ইত্যাদি গানগুলো আছে যেগুলোর কথা মন মাতায়। শুধু তাই নয়, তিনি সুরস্রষ্টা হিসেবেও অনন্য ছিলেন। তিনি শচীন দেববর্মণের সুনামধন্য কর্মজীবনের এ সুচারু পরামর্শদাতা ছিলেন, যা তার গানে আরও প্রভাব বিস্তার করেছে।

আরও পড়ুনঃ  নয়নতারা (অভিনেত্রী)

অপরদিকে, কিশোর কুমার বাংলা সংগীতে অবদান রেখে গেছেন তার অনন্য সুর, গানের কথা এবং হৃদয়ে সরাসরি পৌঁছানোর ক্ষমতার মাধ্যমে। তার গাওয়া গানগুলো স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা সংগীতের জগতে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। এমনকি, কিশোর কুমারের কণ্ঠস্বর আজও নতুন প্রজন্মের মন কেড়ে নেয়।

Kishore Kumar এর মধুর কণ্ঠের জাদু

কিশোর কুমারের মধুর কণ্ঠের জাদু আমাদের মনকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে। তাঁর গান এবং সুরের বৈচিত্র্য বাংলা গানের ইতিহাসে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। তিনি ধ্রুপদী, রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে রক অ্যান্ড রোল পর্যন্ত নানা ধারার গান গেয়ে আমাদের শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছেন।

ধ্রুপদী এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত

কিশোর কুমার ধ্রুপদী গান এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার ক্ষেত্রে অনন্য দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘গোলমাল’ ছবিতে ‘গোলমাল হ্যায় ভাই সব গোলমাল হ্যায়’ গানটি তার কণ্ঠে বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পঞ্চম চোখের ধান্দায় ও ‘মেরে নয়না সাওন’ বা ‘মন বেহেক রাহা’ গানগুলির উপস্থাপনার সময়েও তার কণ্ঠের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। বঙ্গসংগীতে সালিল চৌধুরীর যুগে, তাঁর সঙ্গীতচর্চা বাংলা গানে বিশেষ অঞ্চলে যায়।

রক অ্যান্ড রোল এবং অন্যান্য ধারায়

কিশোর কুমার শুধুমাত্র ধ্রুপদী এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি রক অ্যান্ড রোল এবং অন্যান্য আধুনিক ধারার গানেও ছিলন পরীক্ষামূলক। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা অমিত কুমারের সাথে যৌথ উপস্থাপনায় যেমন ‘তুম হো মেরি দিল কি ধড়কন’ গানে প্রমাণিত হয়েছে। পঞ্চম-অমিত কুমারের ‘তু মেরি মেহবুবা হ্যায়’ গানটির নির্দেশন, গঠন এবং অ্যারেঞ্জমেন্ট তুলে ধরে তার রকের প্রতি ভালোবাসা। তাঁর গানগুলি প্রমাণ করে দেয় যে কিশোর কুমারের কণ্ঠ বাংলা সংগীতের অমর সম্পদ।

বহুমুখী প্রতিভা

কিশোর কুমার ছিলেন একজন সত্যিকারের বহুমুখী প্রতিভা, যার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সৃজনশীলতা এবং বৈচিত্র্যের ছাপ ছিল। তার কর্মজীবনের শুরুতে মাত্র কয়টি ছবি সুপারহিট হলেও, কিশোর কুমার তার বৈচিত্র্যময় প্রতিভার জোরে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বাবা গান্ধীর “শিকারি,” “লুকোচুরি,” “নোকারি,” এবং “ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট” ইত্যাদি ছবিতে তার অনবদ্য অভিনয় তাকে আলোচনায় আনে।

আরও পড়ুনঃ  আফরান নিশো: বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা

১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র “লুকোচুরি” তে কিশোর কুমারের অভিনয় এবং কামাল মজুমদারের পরিচালনা তাকে বড় পরিসরে পরিচিতি দেয়। এছাড়াও, ১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “বধতি কা নাম দাড়ি” চলচ্চিত্রেও তার অভিনয়া এবং পরিচালনায় শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন। এতে তিনি অমিত কুমার এবং বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। তার বহুমুখী প্রতিভা শুধু অভিনয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না।

গীতিকার ও সুরকার কিশোর কুমার

কেবল চলচ্চিত্র নায়ক হিসেবেই নয়, কিশোর কুমার তার অসাধারণ গীতিকার এবং সুরকার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। “দূরী কা রাহি” চলচ্চিত্রে তিনি নিজেই সঙ্গীত রচনা করেন এবং একাধিক গান লেখেন যা তাকে প্রগাঢ় প্রশংসা এনে দেয়। তার কল্পনাশক্তি এবং সৃষ্টিশীলতার জন্য তিনি সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

অসংখ্য গানের ওস্তাদ

কিশোর কুমারের পেশাদার জীবনজুড়ে তাকে প্রায় দুইশো পঁয়তাল্লিশটি গান রাজেশ খান্নার জন্য গাইতে বলা হয়েছিল। এতে তিনি তার স্বনির্মিত স্টাইল তৈরি করে সকলের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গ্রহণ করেন। বলিউডের বিভিন্ন ভাষায় গোনা যায় এমন বহু গানের মধ্যে তার উদাহরণস্বরূপ “শারাবি ড্যাডি,” “দুর গগন কি ছাঁও মে,” ইত্যাদি ছবিতে তার প্রতিভার প্রদর্শন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সংগীত জগতে কিশোর কুমারের অনুকরণের ধারা ও অপ্রথাগত পদ্ধতি তার দীর্ঘায়ু প্রতিষ্ঠিত করে।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button