আম

আম একটি জনপ্রিয় এবং মিষ্টি ফল। Mango প্রচুর প্রজাতির ম্যাঙ্গিফেরা গণের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উদ্ভিদে জন্মানো সুস্বাদু ফল। কাঁচা ও পাকা অবস্থায় আমের রং সবুজ ও হলুদ হয় যথাক্রমে। এই ফলটির বৈচিত্রতা এবং স্বাদের জন্য এটি সারা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

ভারতে ২০১৯ সালে ২৫.৬ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন হয়েছে যা বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ায় উৎপাদন হয়েছে ৩.৩ মিলিয়ন টন এবং গণচীনে উৎপাদন হয়েছে ২.৪ মিলিয়ন টন। Bangladesh সহ অন্যান্য দেশগুলিতেও আমের ব্যাপক চাষাবাদ হয় এবং এটি একটি প্রিয় ফল হিসেবে পরিচিত।

আমের বৈজ্ঞানিক পরিচিতি

আম, বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ফল, বৈজ্ঞানিকভাবে অ্যানাকার্ডিয়াসিয়েই পরিবার বা Anacardiaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই পরিবারের অংশ হিসেবে, আম জগৎ বা রাজ্যের অংশ হিসেবে প্লান্টি (Plantae) এবং গোষ্ঠী হিসেবে ট্র্যাকিওফাইট (Tracheophytes) এর অন্তর্ভুক্ত। এটি উদ্ভিদের সপুষ্পক (Angiosperm) এবং ইউডিকট (Eudicots) ক্লেডে অন্তর্গত।

অ্যানাকার্ডিয়াসিয়েই পরিবার

আম অ্যানাকার্ডিয়াসিয়েই পরিবারভুক্ত একটি উদ্ভিদ। এই পরিবারের সদস্যরা সপুষ্পক উদ্ভিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এবং সাধারণত রোসিদস গোষ্ঠীর অন্তর্গত। এই পরিবারটির উদ্ভিদগুলো বর্গের মধ্যমণি হল শাপিন্ডালেস। আমের গাছ সপুষ্পক উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম এবং এর কাঠ উওচ্চ মাত্রায় ফেনোলিক পদার্থ উৎপাদন করে।

প্রজাতি Mangifera indica

আমের বৈজ্ঞানিক নাম Mangifera indica। এই নামটি কার্ল লিনিয়াস দ্বারা প্রদত্ত। প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বে ভারতবর্ষে চাষ শুরু হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বে আমের বিভিন্ন প্রজাতি চাষ করা হয়, যার মধ্যে Mangifera indica সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। আম গাছের উচ্চতা প্রায় ৩০ মিটার (১০০ ফুট) এবং গাছের গুঁড়ির পরিধি ৩.৭ মিটার (১২ ফুট) এরও বেশি হতে পারে।

বৈজ্ঞানিক নামকরন

আমের বৈজ্ঞানিক নামকরণ কার্ল লিনিয়াস দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল। এই নামের মাধ্যমে আমের ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্বে এই নাম ব্যবহার করে আমের গাছের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস প্রসঙ্গগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়।

আমের উৎপত্তি ও ইতিহাস

আমের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় এর আদি নিবাস সম্পর্কে। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই মূলত এ ফলের প্রাচীন ফলের বিতরণ শুরু হয়েছিল। এখানে প্রায় ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আমের প্রজাতির চাষ শুরু হয় বলে প্রচলিত রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, ১৭৫৩ সালে, বিজ্ঞানী লিনিয়াস এই প্রজাতিটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করেন।

আরও পড়ুনঃ  ঘি এর উপকারিতা ও অপকারিতা?

আমের আদি নিবাস

আমের আদি নিবাস হিসেবে পরিচিত ভারতীয় উপমহাদেশ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলের উর্বর মাটি ও অনুকূল জলবায়ুর কারণে আম গাছের প্রাচীন ফলের বিতরণ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়।

বিশ্বে আমের বিস্তার

ভারত, ইন্দোনেশিয়া, গণচীন, মেক্সিকো, পাকিস্তান এবং ব্রাজিলসহ নানা দেশে আমের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। এই দেশগুলোতে আমের উৎপাদন ও চাষাবাদ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে চলেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ভারতে প্রায় ২৫.৬ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন হয়। বাংলাদেশে ২০০৫-০৬ সালে প্রায় ৬,৩৯,৮২০ মেট্রিক টন আম উৎপন্ন হয়েছিল।

মোগল আমলে আমের প্রচলন

মোগল সাম্রাজ্যের সময় আম বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। মোগল সম্রাটদের বিলাসিতার প্রতীক হিসেবে আমের প্রচলন ব্যাপকভাবে হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। মোগল আমলে আমের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ এবং এ সময় আমের চাষাবাদ ও ফলের সুনাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ে।

পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্যাবলী

আমের বিভিন্ন ধরণ এবং তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে নেওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বিভিন্ন ধরনের আম এবং তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানার মাধ্যমে আমরা আমের গুণাগুণ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা সম্ভব।

আমের বিভিন্ন ধরণ

আমের ধরন বিভিন্ন হতে পারে। এটি হাড়ি, ফজলি, ল্যাংড়া ইত্যাদি নামে পরিচিত। প্রতিটি আমের ধরন বিশেষ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যা উপভোগকারীদের মধ্যে প্রচলিত। আমের ধরন অনুসারে এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ ভিন্ন হয়।

আম গাছের আকৃতি

আম গাছের আকৃতি সাধারণত বৃহৎ হয় এবং এটি প্রায় ৩৫-৪০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতা পৌঁছাতে পারে। আম গাছের পাতা অনেক বড় ও সবুজ হয় যা ফলের বীজের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগায়। আম গাছের আকার বড় হওয়ায় এটি বিভিন্ন আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম।

আমের রং ও আকার

আমের ফল বিভিন্ন রং এবং আকারে পাওয়া যায়। আম যখন কাঁচা থাকে তখন এর ফলের রং সাধারণত সবুজ হয়, কিন্তু পাকা অবস্থায় এটি সোনালি হলুদ রং ধারণ করে। আমের আকারও বিভিন্ন হতে পারে, যা নির্ভর করে আমের ধরন ও বংশানুক্রমে।

মিষ্টি ও সুস্বাদু আমের জনপ্রিয়তা

বাংলাদেশে মিষ্টি আম বিশেষভাবে জনপ্রিয়, কারণ এটি স্বাদে অতুলনীয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আম প্রায়শই খাওয়া হয়, কিন্তু বাংলাদেশে এর খাবারের জনপ্রিয়তা আলাদা। এই ফলটি শুধু তার মিষ্টত্বই নয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের আমের স্বাদও বেশ বিশ্বখ্যাত।

  • ফজলি আম: উচ্চতা ৭.৮ সেমি, প্রস্থ ৯.৫ সেমি এবং দৈর্ঘ্য ১৩.৮ সেমি। ওজন প্রায় ৬৫৫ গ্রাম।
  • ল্যাংড়া আম: ওজন ২০০ থেকে ৫০০ গ্রাম এবং সাধারণত জুলাই থেকে আগস্ট মাসে পাকে।
  • হিমসাগর আম: অনন্য মিষ্টত্ব ও সুগন্ধের জন্য বিখ্যাত।
আরও পড়ুনঃ  গরম মসলা

মিষ্টি ও সুবাসিত ল্যাংড়া আমের মতো, ফজলি ও হিমসাগর আমও স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বৃহত্তর আসন পেয়েছে। এই বৈচিত্র্যময় আমগুলোর কারণে বাংলাদেশে আমের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। প্রতিটি আমের স্বাদ ভিন্ন এবং সকলেই তাদের নিজস্ব বিশেষত্বে সুস্বাদু ও মনোমুগ্ধকর।

আমের জনপ্রিয়তা শুধু স্বাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর পুষ্টিগুণও অসাধারণ। ভিটামিন সি, বিটা-ক্যারোটিন, পটাশিয়াম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ আম বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি। বিশেষত, মিষ্টি আমের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে শর্করা এবং ফাইবার, যা শরীরের শক্তি বাড়াতে এবং হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে আমের খাবারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো এর বৈচিত্র্য এবং সুমিষ্ট স্বাদ। বিভিন্ন প্রজাতির আমের মিশ্রণ একে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। স্থানীয় ফুড ফেস্টিভ্যাল এবং বাজারগুলোতে এই মিষ্টি এবং সুস্বাদু আমের চাহিদা অত্যন্ত বেশি।

বাংলাদেশে উৎপাদিত আমের পরিচিতি

বাংলাদেশে চাষ করা হয় অনেক ধরনের আম। ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ও মোহনভোগ এগুলো বাংলাদেশে উৎপাদিত কিছু জনপ্রিয় আমের নাম। এসব আম গুণগত মান ও স্বাদে বেশ উন্নত।

ফজলি

ফজলি আম সাধারণত বাজারে আসে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এটি আকারে লম্বা, রং হলুদ এবং স্বাদে মিষ্টি ও খানিকটা অম্লীয়। বাংলাদেশের আমের মধ্যে ফজলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তার সুমিষ্ট ও সুস্বাদু স্বাদের জন্য।

ল্যাংড়া

ল্যাংড়া আমের প্রাপ্যতা শুরু হয় মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এটি আকারে মাঝারি ও গোলাকার, রং হালকা হলুদ বা সবুজাভ হয়। এর স্বাদ বেশ মিষ্টি। বাংলাদেশের আম হিসেবে ল্যাংড়া প্রচলিত এবং স্বাদে অনন্য।

গোপালভোগ

গোপালভোগ আম মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুন মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়। এটি অন্যতম বিখ্যাত আম রাজশাহীতে। আকারে ছোট হওয়া সত্ত্বেও গোপালভোগ তার মিষ্টতা ও স্বাদে বাংলাদেশের আমপ্রেমীদের প্রিয়।

মোহনভোগ

মোহনভোগ বাংলাদেশের আরেকটি সুস্বাদু আম যা বিশেষ করে রাজশাহীতে প্রচুর চাষ হয়। এই আম সাধারণত পাকার পর একটি উজ্জ্বল হলুদ রঙ ধারণ করে। স্বাদের দিক থেকে মোহনভোগ সম্পূর্ণ মিষ্টি, যা খাবার সময়ে অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।

আরও পড়ুনঃ  কেওড়া ফল

বিশেষ ধরনের বাদশভোগ mango

বাংলাদেশে উৎপাদিত বিশেষ জাতের আমগুলির মধ্যে বাদশভোগ আম একটি উল্লেখযোগ্য নাম। এই বিশেষ ধরনের আম তার অনন্য স্বাদ ও বৈশিষ্ট্যের জন্য জনপ্রিয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগানগুলোতে বাদশভোগ আমের খ্যাতি যেমন বিশিষ্ট, তেমনি এর মানও অনন্য।

বাদশভোগ আমের বিশেষত্বের মূল কারণ হল এর মিষ্টি, রসালো ও ঘন মাংস। এই আমের খোসা পাতলা হওয়ার কারণে এটি খেতে বেশ সুবিধাজনক। যখন বাদশভোগ আম পরিপূর্ণরূপে পাকে, তখন এর রং হয়ে যায় উজ্জ্বল হলুদ। এই আমের মিষ্টতা এবং রস থাকার জন্য এটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু।

বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে বিভিন্ন বিশেষ জাতের আম চাষ হলেও বাদশভোগ আম বিশেষ ভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে প্রচুর মাত্রায় উৎপাদিত হয়। এই বিশেষ জাতের আমের জন্য, চাষীদের অনেক যত্ন এবং সঠিক পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশে বাদশভোগ আমের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অনেক উন্নত কৌশল এবং ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করা হয়েছে। দেশের বাগানগুলোতে এই বিশেষ জাতের আম চাষ করে চাষীরা লাভবান হয়েছেন।

আমাদের দেশীয় বাজারে বাদশভোগ আম অনেক চাহিদা পূরণ করে এবং বিদেশে আম রপ্তানিতে এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এমনকি এই আমের স্বাদ ও মানের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রশংসিত।

আম চাষের পদ্ধতি

বাংলাদেশে আম চাষ একটি বিশেষ যত্ন এবং পদ্ধতির প্রয়োজন। আমচাষীদের জন্য সঠিক বপনের সময়, সেচ ব্যবস্থা এবং পরিবেশগত প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত জাতের আম যেমন বারি আম-১ থেকে বারি আম-৯ এবং এফ১ হাইব্রিড জাতের আম চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।

বপনের সময় ও পদ্ধতি

আম বপনের সর্বোত্তম সময় জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়/ভাদ্র-আশ্বিন (মে-জুন/আগস্ট-সেপ্টেম্বর) মাস। প্রতি গর্তে একটিমাত্র বীজ বপন করা উচিত। গর্তে সার প্রয়োগের মিশ্রণ হিসেবে প্রতি গর্তে ২২ কেজি গোবর, ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫৫০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০ গ্রাম এমওপি, ৩০০ গ্রাম জিপসাম এবং ৬০ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট ব্যবহার করা উচিত।

সেচ ব্যবস্থা

আম গাছের সঠিক বৃদ্ধির জন্য সঠিক সেচ ব্যবস্থা অপরিহার্য। বর্ষা মৌসুমে প্রায়শই অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজন হয় না, তবে শুকনো মৌসুমে নিয়মিত সেচ দেওয়া জরুরি। নিকাশী ব্যবস্থা যাতে সঠিক থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে, কারণ অতিরিক্ত জলাবদ্ধতা গাছের ক্ষতি করতে পারে।

পরিবেশ ও আবহাওয়া

আম চাষের জন্য উপযুক্ত মাটি পিএইচ স্তর ৫.৫ থেকে ৭.০ হওয়া উচিত। সঠিক ফলনের জন্য মাটির অম্লতার উপরে নিয়মিত নজর রাখা উচিত। ভালো মানের আমের জন্য গড় তাপমাত্রা এবং রোদযুক্ত আবহাওয়া প্রয়োজন।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button