মুক্তারপুর সেতু

মুন্সীগঞ্জ জেলার মুক্তারপুর সেতু, যা ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নামেও পরিচিত, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং মুন্সীগঞ্জ জেলাকে সংযুক্ত করে। মুন্সীগঞ্জ সদরের কাছাকাছি এই গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি ২০০৮ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়। এর অবস্থানগত সমন্বয় ২৩.৫৬৯৭° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০.৫১২৫° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে।

মুক্তারপুর সেতুটি ধলেশ্বরী নদী অতিক্রম করে, যার প্রতিটি স্প্যান প্রশস্ত ১০ মিটার এবং উচ্চতা ১৮.২৯ মিটার। ১,৫২১ মিটার দীর্ঘ এই ব্রিজটির মোট নির্মাণ ব্যয় ছিল ২০৮.৩৫ কোটি টাকা। ৩৭টি স্প্যান এবং ১২৬টি পাইলসহ এই সেতুটি মুন্সীগঞ্জ জেলার কৃষিপণ্য যেমন ফল ও শাকসবজি ঢাকায় পরিবহণে সুবিধা প্রদান করে৷

মুক্তারপুর সেতুর অবস্থান

মুন্সীগঞ্জ জেলায় অবস্থান করা মুক্তারপুর সেতু, যা মুন্সীগঞ্জ সদর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই সেতু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং মুন্সীগঞ্জকে সহজ যাতায়াতের সুযোগ প্রদান করে থাকে এবং এই তিন জেলার মধ্যে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

মুন্সীগঞ্জ জেলার গুরুত্ব

মুন্সীগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কেন্দ্র। এই জেলার খাদ্য শস্য ও কৃষিপণ্যের উত্পাদন এবং সরবরাহ এলাকাগুলি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তারপুর সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলার স্থানীয় কৃষি ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম আরো গতিশীল হয়েছে। ঢাকা সংযোগ এবং নারায়ণগঞ্জ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এই জেলার গুরুত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ও মুন্সীগঞ্জ সংযোগ

মুক্তারপুর সেতু ঢাকা সংযোগকে আরো মজবুত করেছে এবং নারায়ণগঞ্জ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই সেতু তিনটি জেলাকে সহজ ও দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যমে যুক্ত করে, যা ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে মুন্সীগঞ্জ জেলার সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করেছে। এভাবে, মুন্সীগঞ্জ জেলা বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, যেখানে মুক্তারপুর সেতুর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আরও পড়ুনঃ  মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল

মুক্তারপুর সেতুর ইতিহাস

মুক্তারপুর সেতু ইতিহাস এক বিশেষ অংশ যা মুন্সীগঞ্জ জেলার গর্বের প্রতীক হিসেবে দাড়িয়ে আছে। সেতুটি ধলেশ্বরী নদীর উপর স্থাপন করা হয়, যা এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে আসে। এর কারণে মুন্সীগঞ্জের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব পড়ে এবং ব্যাপক পরিবহন সুবিধা লাভ করে।

নির্মাণ পূর্ব ইতিহাস

মুক্তারপুর সেতু নির্মাণের আগে, এই অঞ্চলের মানুষ ধলেশ্বরী নদী ট্রলারে পারাপার হতো। তাদের জন্য এটি ছিল সময় সাপেক্ষ এবং বিপজ্জনক। তাই মুন্সীগঞ্জ জেলার উন্নয়ন এবং জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে মুক্তারপুর সেতু নির্মাণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

নির্মাণের কারিগরি দিক

সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া ২০০৮ সালে শেষ হয়েছে। মুক্তারপুর সেতু ইতিহাসগঠনে China Road and Bridge Corporation (CRBC) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ১,৫২১ মিটার, প্রস্থ ১০ মিটার, এবং উচ্চতা ১৮.২৯ মিটার। ৩৭টি স্প্যান সহকারে নির্মিত এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় ছিল ২০৮.৩৫ কোটি টাকা।

মুক্তারপুর সেতুর স্থাপত্য

মুক্তারপুর সেতু বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম সেতু। এর স্থাপত্যের নকশা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে করা হয়েছে, যা সেতুটির শক্তি এবং স্থায়িত্বকে নির্দেশ করে। চলুন দেখি কীভাবে এটির স্থাপত্যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এসেছে।

প্রিস্ট্রেস কনক্রিট ব্যবহারের উল্লেখ

মুক্তারপুর সেতুর স্থাপত্যে প্রিস্ট্রেস কনক্রিট ব্যবহারের কারণে এটি অতিরিক্ত শক্তি এবং টেকসইতা অর্জন করেছে। প্রিস্ট্রেস কনক্রিট ব্যবহার করার ফলে সেতুটি ভারবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এটিকে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার উপযোগী করেছে।

দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ

মুক্তারপুর সেতুর দৈর্ঘ্য মোট ১৫২১ মিটার এবং প্রস্থ ১০ মিটার। এই উপলক্ষে, সেতুটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেতু হিসেবে বিবেচিত হয়। সেতুর দৈর্ঘ্য এবং সেতুর প্রস্থ এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে এগুলি সেতুর অবকাঠামোকে দৃঢ় এবং টেকসই করে তোলে।

সেতুর নির্মাণ কার্যক্রম

মুক্তারপুর সেতুর নির্মাণ কার্যক্রম বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল প্রকল্প ছিল। এই সেতু যেমন নির্মাণকাজের জটিলতা তেমনই প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের অবদানকে তুলে ধরে।

বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের ভূমিকা

মুক্তারপুর সেতুর নির্মাণকাজে বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা সেতুর নকশা, প্রিস্ট্রেস কনক্রিট ব্যবহারে নির্দেশনা এবং সেতুর স্থিতিশীলতা-তে ব্যাপক গবেষণা করেন। বাঁকা ৩৭টি স্প্যান সহ সেতুর প্রয়োজনীয়তা এবং দৈর্ঘ্য নিয়ে বিচক্ষণ দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন বিজ্ঞানীরা।

আরও পড়ুনঃ  চন্দ্রনাথ মন্দির

নির্মাণ ব্যয় ও অর্থায়ন

মুক্তারপুর সেতুর নির্মাণ ব্যয় ছিল ২০৮.৩৫ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন ৭৯.১৫ কোটি টাকা, এবং বাকি ১২৯.২০ কোটি টাকা প্রকল্প সাহায্য হিসেবে পাওয়া যায়।

সেতু নির্মাণের অর্থায়ন বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি বিদেশি সহায়করাও করেছে। ২০০৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এই সেতুটি উদ্বোধন করা হয়, যা মুন্সীগঞ্জ এবং আশপাশের এলাকাগুলির কৃষিপণ্য পরিবহন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সহজ করেছে।

Muktarpur Bridge এর অর্থনৈতিক প্রভাব

মুক্তারপুর সেতুর নির্মাণের ফলে মুন্সীগঞ্জ ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোতে অর্থনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত ইতিবাচক হয়েছে। এই সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, যা এলাকার স্থানীয় এবং বৃহৎ পরিসরের অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন এনেছে।

কৃষিপণ্য পরিবহন সুবিধা

মুক্তারপুর সেতুর মাধ্যমে কৃষিপণ্য পরিবহন অত্যন্ত সহজ এবং দ্রুত হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ এবং আশপাশের কৃষি এলাকার কৃষিপণ্য এখন খুব সহজেই ঢাকা মহানগরীতে পৌঁছাতে পারছে। ফলে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উত্তোরত্তর উন্নত হয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি

মুক্তারপুর সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব অন্যত্রও স্পষ্ট হয়েছে। সেতুর মাধ্যমে জেলাটির স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ঘটেছে। ব্যবসায়ীদের জন্য পরিবহন খরচ কমে যাওয়ায় এবং সহজে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় তাদের কার্যক্রমে উন্নতি হয়েছে। এই প্লাটফর্মটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

মুক্তারপুর সেতুর পর্যটন আকর্ষণ

মুক্তারপুর সেতু পর্যটন এর জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর দৃশ্য বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময় পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত মুগ্ধকর হয়ে ওঠে। নদীর স্নিগ্ধ পরিবেশ এবং মুক্তারপুর সেতুর অনন্য স্থাপত্য পর্যটকদের কাছে খুবই প্রিয়।

মেঘনা ভিলেজ হলিডে রিসোর্ট এর নতুন সংযোজন ৩ডি সিনেপ্লেক্স, যেখানে একসঙ্গে ২০ জন দর্শক বসে ছবি দেখতে পারেন। প্রথমবারের মতো এখানে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য টিকেট দাম মাত্র ৫০ টাকা এবং শিশুদের জন্য ১০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিবার এবং বন্ধুদের নিয়ে এখানে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মনোরম ধলেশ্বরী নদীর দৃশ্য উপভোগ করার জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।

আরও পড়ুনঃ  বুর্জ খলিফা কত তলা?

রিসোর্টে ভাগ্নাদোলা, মেরিগো রাউন্ড, সাইকেল চালনা, ব্যাটারী কার ও মিকি মাউস বাইক সহ বিনোদনের নানা আয়োজন রয়েছে। এ সকল কার্যকলাপ এবং তিন-মাত্রিক সিনেমা দেখার সুযোগ মুক্তারপুর সেতু পর্যটন এর আকর্ষণকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

ঢাকা-পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে অবস্থিত প্রায় ১৩৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের আড়িয়াল বিল থেকে ঢাকা ফিরে আসার সময় সেতু থেকে নদীর অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এ সময় দর্শনার্থীরা নদীর তীরে বাইকিং বা হাঁটতে পারেন, যা তাদের মনে দারুণ প্রশান্তি দেয়।

পরিশেষে, মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে দর-দামসাপেক্ষে অটো বা সিএনজি রিজার্ভ নিয়ে সহজেই দিনে দিনে ঘুরে এসে ধলেশ্বরী নদীর সৌন্দর্য এবং মুক্তারপুর সেতুর পর্যটন আকর্ষণ উপভোগ করা যায়। এই সেতুর চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং অন্যান্য বিনোদনের সুযোগ সুবিধা মুক্তারপুর সেতুকে একটি আদর্শ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরেছে।

ধলেশ্বরী নদীর সৌন্দর্য

মুক্তারপুর সেতু ধলেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে, যা ঢাকার নিকটবর্তী সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন নদীগুলির মধ্যে অন্যতম। এই সেতু থেকে নদীর চমৎকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বিশেষ করে শেষ বিকেলের সময়, যখন সূর্য ধলেশ্বরীর পানিতে প্রতিফলিত হয়, তখন সেতুর উপর থেকে দেখা দৃশ্য এক অপরূপ সাহিত্যের পদ্যর মতো মনে হয়।

সূর্যাস্তের দৃশ্য

মুক্তারপুর সেতু থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য এক ইন্দ্রিয়মধুর অভিজ্ঞতা। ধলেশ্বরীর শ্যামল জল কখনও স্রোত, কখনও স্থির, স্বর্গীয় আলোকছটায় ছেয়ে থাকে। সূর্যের শেষ রশ্মি যখন ধীরে ধীরে হেলে পড়ে নদীর বুকের উপর, তখন সেই মুহূর্ত মন ভরে দেয় প্রশান্তিতে।

প্রায় ১৫ মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে আপনি যদি সঠিক সময়ে পৌছাতে পারেন, ধলেশ্বরীর পরিপূর্ণ সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। এখানে নৌকা ও ট্রলার চলাচল করে, যা নদীর সৌন্দর্যকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। নদীর তীরবর্তী মানুষেরা এখানে সাঁতার কাটেন বা জলের সাথে ধুয়ে নিজেদের পরিপাটি করেন। এই দৃশ্য ধলেশ্বরীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button