সাকিব আল হাসান: বাংলাদেশ ক্রিকেটের কিংবদন্তি
সাকিব আল হাসান হলেন এক অসম্ভব প্রতিভাবান অলরাউন্ডার, যা তাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে কিংবদন্তি করে তুলেছে। তার অসাধারণ পারফরম্যান্স ও নেতৃত্বের কারণে, সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের অন্যতম প্রধান কারিগর। তার ক্যারিয়ারে ৬৫টি টেস্ট ম্যাচে ৪,৩৬৭ রান এবং ২৩১ উইকেট, ২২৭টি ওডিআই ম্যাচে ৬,৯৭৬ রান ও ৩০০ উইকেট, এবং ১০৯টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ২,২৪৩ রান ও ১২৮ উইকেট সংগ্রহ করে, সাকিব বেশ কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
তার ক্যারিয়ারের বিভিন্ন মাইলফলকের মধ্যে, ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসান ৬০৬ রান এবং ১১ উইকেট নিয়ে তার নাম বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক রান সংগ্রাহকদের তালিকায় তুলে ধরেন। তাছাড়া, তিনি আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে অলরাউন্ডার হিসেবে প্রথম স্থানে অবস্থান করছেন। সর্বোপরি, তার অসাধারণ পারফরম্যান্স ও অবদানে, তিনি সত্যিই বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন।
সাকিব আল হাসানের প্রাথমিক জীবন
সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার, তার প্রারম্ভিক জীবনকে ঘিরে অনেক কৌতূহলী তথ্য রয়েছে। তার জন্ম ও পরিবারের প্রেক্ষাপট তাকে যে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি গুরুত্বপূর্ণ।
জন্ম ও পরিবার
সাকিব আল হাসানের জন্ম হয়েছিল ১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ মাগুরা জেলায়। তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন, যা সাকিবের ক্রীড়া অনুরাগের অন্যতম প্রধান কারণ। তার বাবা মাশরুর রেজা একজন ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন এবং মা শিরিন রেজা তাকে সবসময় খেলাধুলায় উৎসাহ দিতেন।
শৈশব ও খেলাধুলা
সাকিবের শৈশবে প্রচুর খেলাধুলার স্মৃতি রয়েছে। সাকিব আল হাসান প্রারম্ভিক জীবন এর কথা বলতে গিয়ে সাকিব অনেকবার বলেছেন, যেন খেলাধুলা তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে পূর্ণ করে তুলেছিল। শৈশবে তিনি ফুটবল, ব্যাডমিন্টন এবং ক্রিকেট খেলতেন, কিন্তু ধীরে ধীরে ক্রিকেটের প্রতিই তার গভীর আগ্রহ জন্মায়।
প্রথমে তিনি একজন পেস বোলার হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে স্পিনে মনোযোগী হন। তার প্রথম ক্রিকেট কোচ সাইয়েদ সাদ্দাম হোসেন গোরকি তাকে যথেষ্ট সহায়তা করেন এবং তার খেলার ধারা উন্নত করেন। এই প্রাথমিক কোচিং সেশনগুলোই সাকিব আল হাসানকে তার পরবর্তী জীবনে ক্রিকেটে সফল হতে সাহায্য করেছিল।
এভাবেই সাকিব আল হাসান প্রারম্ভিক জীবন তাকে আজকের ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার হিসেবে গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করেছে।
বিকেএসপিতে সাকিবের প্রশিক্ষণ
সাকিব আল হাসান তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুতেই বিকেএসপিতে ভর্তির মাধ্যমে তাঁর দক্ষতার উন্নতি শুরু করেন। বিকেএসপির উচ্চমানের প্রশিক্ষণ এবং কোচিং তাঁকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অলরাউন্ডারের মর্যাদায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
প্রথমে মনোনয়ন
সাকিবকে বিকেএসপিতে মনোনীত করা হয়েছিল তাঁর অসাধারণ প্রতিভার কারণে। তিনি শৈশব থেকেই ক্রিকেটে দক্ষ ছিলেন এবং বিকেএসপি তাঁর সেই প্রতিভাকে সঠিকভাবে গাইড করতে অবদান রেখেছে। প্রথমে কিছু পরীক্ষার পরই তিনি মনোনীত হন এবং সাধারণত ক্রীড়াবিদদের ভর্তির পূর্বে যে কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, তা পাশ করে বিকেএসপিতে যোগদান করেন।
গুরুত্বপূর্ণ কোচ ও প্রশিক্ষণ
সাকিব আল হাসান প্রশিক্ষণ পর্ব শুরু করেন বিকেএসপিতে, যেখানে তিনি বিখ্যাত কোচদের অধীনে প্রচুর দক্ষতা অর্জন করেন। বিকেএসপির কোচিং শুধু ক্রিকেটীয় দক্ষতা উন্নত করাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং মানসিক দৃঢ়তা, শারীরিক সক্ষমতা এবং কৌশলগত প্রস্তুতিতেও গুরুত্ব দিয়েছিল।
- ডেভ হোয়াটমোর: তাঁর কোচিং সাকিবকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশাল উন্নত করে তুলেছে।
- চন্ডিকা হাতুরুসিংহে: তাঁর কঠোর প্রশিক্ষণ সাকিবকে ফিটনেস এবং আত্মবিশ্বাসের দিক থেকে সুদক্ষ করে তোলে।
- মিউরেলিথারান: স্পিন বোলিংয়ে সাকিবকে সূক্ষ্মতা ও নিখুঁততা শিক্ষিয়েছেন।
অনেক প্রচেষ্টার পর এবং এগিয়ে যেতে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করার ফলে, সাকিব আল হাসান বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ শেষে একজন সক্ষম অলরাউন্ডার হিসেবে উত্থান ঘটান। সাকিবের বিকেএসপি ক্যারিয়ারের কোচিং পর্বই তাঁকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের অভিষেক
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলির মধ্যে একটি হলো সাকিব আল হাসান অভিষেকের দিনগুলো। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেকের সময় থেকে তিনি অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করে যাচ্ছেন, যা তাকে এই প্রজন্মের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ওয়ানডে অভিষেক
সাকিব আল হাসানের ওয়ানডে অভিষেক ঘটে ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এই ম্যাচে তিনি ব্যাট হাতে নেপথ্যে ছিলেন দলের জয়ের জন্য। বল হাতে তেমন সুযোগ না পেলেও, তার অভিষেক দিনেই সকলকে নিয়ে আসে তার ভবিষ্যৎ প্রতিভার প্রতি আভাস।
টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট অভিষেক
সাকিবের টি-টোয়েন্টি অভিষেক ঘটে মাত্র দুই মাস পর, ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বরে। এই ফরম্যাটে দ্রুতই নিজেকে প্রমাণ করে তোলেন তিনি। তবে, তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যাত্রার সবচেয়ে বড় মাইলফলক ছিল ২০০৭ সালের ১৮ মে ভারতের বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক।
সাকিব আল হাসানের টেস্ট অভিষেক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেখানে তিনি শুরু থেকেই অসাধারণ পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে যান। সাকিব আল হাসান অভিষেকের পর থেকে টেস্ট ক্রিকেটে তার ৫ উইকেটের আরও অনেক রেকর্ড যোগ হয়। আজ পর্যন্ত তিনি ১৫ বারেরও বেশি ইনিংসে ৫ উইকেট দখল করেছেন, যা তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল বোলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকে সাকিব আল হাসান একাধিকবার ৫ উইকেট নিয়ে নোটবুকে নাম লিখিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ উইকেট নেয়া তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স।
শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবে সাকিবের ক্যারিয়ার
শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়ন একটি বহুল প্রশংসিত বিষয়। সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটারদের একজন হিসেবে মনে করা হয় এবং তার ক্যারিয়ারেও শেখ হাসিনার সরকারের রাজনৈতিক প্রভাব বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাব
রাজনৈতিক পরিবেশের চাপ এবং শেখ হাসিনার সরকারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারের উপর প্রভাব ফেলেছে। সাকিব আল হাসানের আন্তর্জাতিক ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলা এবং বাংলাদেশের হয়ে খেলা বন্ধ ছিল রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য। সাম্প্রতিককালে শেখ হাসিনার সরকারের নিচে রাজনৈতিক সমস্যার প্রভাবে সাকিবের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছিল, যাতে তিনি বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ম্যাচ মিস করেছেন।
নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা
সাকিব আল হাসান এবং অন্যান্য ক্রিকেটারদের জন্য নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনা সরকারের নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাকিবের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তত্ত্বাবধান করা এবং তার খেলার স্বাধীনতা বজায় রাখা, যে কোন প্রকার রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা নীতিগুলির একটি অংশ ছিল। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সাকিবের ফিরে আসার ব্যাপারে আশা করছে, তবে তা নির্ভর করছে অনেক আইনি ও প্রশাসনিক বিষয়ের সমাধানের উপর।
ক্রিকেটে ঘরোয়া লীগে সাকিবের অবদান
সাকিব আল হাসান কেবল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই নয়, ঘরোয়া ক্রিকেটেও তাঁর বিরাট অবদান রেখেছেন। ঘরোয়া লীগে সাকিবের উপস্থিতি যে কোনো দলের জন্যই অনেক বড় সম্পদ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ঘরোয়া লীগে সাকিবের দাপট এবং সাফল্য তাঁর প্রতিভা এবং নেতৃত্বের গুণাবলীকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে।
বিপিএল – বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে, সাকিব আল হাসান ঢাকা ডায়নামাইটস এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে খেলেছেন। তাঁর সেরা পারফর্মেন্স দলগুলোর পারফর্মেন্সকে আরও শানিত করেছে। বিপিএলের মাধ্যমে সাকিবের অসাধারণ ব্যাটিং এবং বোলিং পারফর্মেন্স উঠে এসেছে, যা তাঁকে ঘরোয়া ক্রিকেটের একজন মেধাবী খেলোয়াড় হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত করেছে।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ – সাকিব ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলে ঘরোয়া ক্রিকেটে ঝড় তুলেছেন। এই লীগেও সাকিবের নেতৃত্ব এবং অলরাউন্ড পারফর্মেন্সে দলটির সাফল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতীয় ক্রিকেট লীগ – সাকিব ঘরোয়া লীগ ঘরোয়া ক্রিকেটে বরিশাল এবং খুলনার হয়ে খেলে তাঁর দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। ইনিংসে ৪ এবং ৫ উইকেট নিয়ে সাফল্য অর্জন করেছেন, যা দলের পারফর্মেন্সে এবং শ্রোতাদের মাঝে বাড়তি উন্মাদনা যোগ করেছে।
সাকিব আল হাসান ঘরোয়া ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ঘরোয়া লীগগুলোতে তাঁর স্বাক্ষর সবসময়ই দৃশ্যমান। তাঁর জায়গায় নাম থাকা মানেই পুরো দলের মনোবল বৃদ্ধি পায়। ঘরোয়া ক্রিকেটে সাকিবের এ অবদানে তাঁর ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ার আরও মজবুত ভিত্তি লাভ করেছে।
আইপিএল ও অন্যান্য বিদেশি লীগে সাকিব
সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক মহানায়ক, যিনি দেশের বাইরে বিভিন্ন লীগে অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছেন। তার অন্যতম বড় অর্জন হলো আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্স দলের সাথে খেলার অভিজ্ঞতা।
কলকাতা নাইট রাইডার্সে সাকিব
আইপিএল-২০২৩ এর নিলামে সাকিব আল হাসানকে দেড় কোটি রুপিতে দলে টেনেছিল বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের দল কলকাতা নাইট রাইডার্স। কলকাতার মাটিতে সাকিবের এই যোগসূত্র তাকে এবং দলকে একত্রিতভাবে আরো শক্তিশালী করেছে। সাকিব ২০১২ ও ২০১৪ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্সে খেলে শিরোপা জিতেছিলেন। আইপিএলে সুদক্ষ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে তিনি দলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, যা দলের সাফল্যের পিছনে একটি বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় লীগে অংশগ্রহণ
সাকিব আল হাসান শুধু আইপিএলই নয়, অন্যান্য জনপ্রিয় লীগেও অংশগ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি ইংল্যান্ড টি-টোয়েন্টি লীগের খসড়ায় সাকিব ছিলেন সবচেয়ে দামী বাংলাদেশি খেলোয়াড়, যার মূল্য £১২৫,০০০ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এটি তার বৈশ্বিক দীর্ঘায়িত জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
তবে সাকিবের অভিজ্ঞতা শুধু তাই নয়, অন্যান্য বিদেশি লীগে খেলতে গিয়ে বেশকিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি হয়েছেন। সম্প্রতি পাকিস্তান সুপার লীগে কিছু পাকিস্তানি খেলোয়াড় নিজেদের সেরা প্রদর্শন করলেও সোচ্চারভাবে বিদেশি লীগে তাদের প্রতি তেমন আগ্রহ প্রকাশিত হয়নি। এর পেছনে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের জন্য বিদেশি লীগে কাজ করার অনুমতি পেতে কিছু সমস্যা রয়েছে, যা অনেকক্ষেত্রেই তাদের নির্ভরশীল পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক মাঠে সাকিব আল হাসানের এমন সাফল্য শুধুমাত্র একটি খেলোয়াড়ী মাইলফলক নয়, বরং বাংলাদেশ ক্রিকেটের গৌরবকেও প্রতিনিধিত্ব করে। তার আইপিএল এবং অন্যান্য লীগে অংশগ্রহণ ভবিষ্যৎ খেলোয়াড়দের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করবে।
সাকিব আল হাসান: একটি জীবন্ত কিংবদন্তি
সাকিব আল হাসান শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয়, বরং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনেও এক প্রভাবশালী নাম। তার অসাধারণ প্রতিভা ও খেলার দক্ষতা তাকে একটি জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বিশ্বমানে স্বীকৃতি
সাকিব আল হাসান প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে চার হাজার রান করার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হন। এছাড়াও, টি২০ তে ১০০০ রান ও ৫০ উইকেট লাভ করেছেন।
২২ জানুয়ারি ২০০৯ তে সাকিব আইসিসি’র ওডিআই অল-রাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বরে উঠে আসেন। তার অসামান্য পারফরম্যান্সের জন্য বিশ্বমানে স্বীকৃতি পেয়েছেন, যা তাকে এক অসাধারণ ক্রীড়াবিদ হিসেবে প্রমাণ করে।
ইতিহাসে স্থান
খেলায় সাকিব আল হাসানের অবদান অমূল্য। টেস্ট ম্যাচে ৬৫টি খেলে ৪৩৬৭ রান এবং ২৩১টি উইকেট সংগ্রহ করেন। সাকিবের সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোর ২১৭ রান যা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক মাইলফলক। ওয়ানডে ম্যাচে তার ৬৯৭৬ রান ও ৩০০ উইকেট সাকিবকে এক ভিন্নমাত্রা প্রদান করে। টি২০ আন্তর্জাতিকে ১০৯ ম্যাচে ২২৪৩ রান এবং ১২৮টি উইকেট নিয়ে সাকিব নিজের ইতিহাস গড়েছেন।
সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপে সর্বোধিক ১২২ রান দেওয়ার মাইলফলক ছুটিয়ে ফেলেন, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক উৎসাহজনক উদাহরণ হিসেবে থাকবে। বিশ্বক্রিকেটের ইতিহাসে তার স্থান নিশ্চিত করেছে যে, তিনি সত্যিকারের জীবন্ত কিংবদন্তি।
অধিনায়কত্ব ও নেতৃত্বে সাকিব
সাকিব আল হাসানের অধিনায়কত্ব বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তার নেতৃত্বে, বাংলাদেশ জাতীয় দল শুধুমাত্র মাঠে সাফল্য অর্জন করেনি, বরং দলের সামগ্রিক মান উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে।
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে প্রথম বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন সাকিব। সেই সময়ে তার নেতৃত্বের শৈলী ছিল একেবারেই প্রগতিশীল। মাঠে তার কৌশলগত সিদ্ধান্ত ও খেলোয়াড়দের মানসিকতা উন্নয়ন ছিল চোখে পড়ার মতো।
সাকিব অধিনায়কত্বের সময়কালে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম হোয়াইটওয়াশ এবং ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজ মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয় উল্লেখযোগ্য। সাকিবের নেতৃত্বে দল আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার মান উন্নয়ন করেছে।
তার নেতৃত্ব গুণ প্রদর্শিত হয় মাঠের বাইরে তরুণ খেলোয়াড়দের উন্নয়নে। অনেক নতুন খেলোয়াড় সাকিবের তত্ত্বাবধানে নিজেদের ধারাবাহিকতা ও দক্ষতা প্রসারিত করেছে। তিনি শুধুমাত্র একজন অধিনায়ক নয়, বরং তরুণ ক্রিকেটারদের মেন্টর হিসেবেও সফল।
সাকিব অধিনায়কত্বে তিনি নিজেও ব্যাট ও বল হাতে অসাধারণ পারফর্ম করেছেন। ২০১৫ সালে তিনি তিন ফরম্যাটেই আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে ছিলেন যা তার নেতৃত্বের দক্ষতার প্রমাণ। তার ব্যাটিং ও বোলিংয়ের ধারাবাহিকতা এবং অধিনায়ক হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
সাকিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দলের সামগ্রিক গঠন এবং কৌশলগত উন্নয়ন ঘটেছে। তার অসাধারণ ক্রীড়া প্রতিভা এবং নেতৃত্ব গুণাগুণ বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান
সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের ক্রিকেটের সোনালী যুগের অন্যতম প্রাণপুরুষ। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান অত্যন্ত সমৃদ্ধ, যা তাকে এক কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত করেছে। এজন্য তার টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি পরিসংখ্যান সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হলো।
টেস্ট ম্যাচ পরিসংখ্যান
সাকিব আল হাসান ৬৫টি টেস্টে অংশগ্রহণ করেছেন যা তাকে একটি অভিজাত স্থান দিয়েছে। তার ব্যাটিং গড় ৩৭.৭৭ এবং সর্বোচ্চ স্কোর ২১৭। তার বলের মায়াজালে টেস্টে ২৪৬ উইকেট প্রাপ্তি হয়েছে, যেখানে তার সেরা বলিং পরিসংখ্যান হল ৭/৩৬। বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনি একটা উল্লেখযোগ্য নাম।
ওয়ানডে ম্যাচ পরিসংখ্যান
অন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সাকিব ২২৫টি ম্যাচে খেলেছেন এবং ২৯.৫২ গড়ে ৩১৭টি উইকেট নিয়েছেন। তার ব্যাটিং গড় ৩৭.২৯ এবং মোট রান ৬৯৭৬। মজার ব্যাপার, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সাকিব অলরাউন্ডারদের মধ্যে অন্যতম সেরা স্থানে রয়েছেন, তিনি অত্যন্ত সফল ছিলেন এবং আজও তাঁর পরিসংখ্যান আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
টি-টোয়েন্টি ম্যাচ পরিসংখ্যান
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সাকিব ১০৯টি ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছেন, যেখানে তার ব্যাটিং গড় ২৩.১৯ এবং মোট রান ২২৪৩। সাকিবের সেরা টি-টোয়েন্টি স্কোর হল ১২৫। তার বলিং দক্ষতা আরও বেশি আকর্ষণীয়, যেখানে ২০.৯১ গড়ে ১৪৯টি উইকেট দখল করেছেন। সহজেই বলা যায় যে, টি-টোয়েন্টি পরিসংখ্যানও তাকে একটি বড় মাপের খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আইসিসি কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা ও প্রত্যাবর্তন
সাকিব আল হাসানের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ২০১৯ সালে আইসিসি কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা। ২৯ অক্টোবর, ২০২০ তারিখে সাকিবের উপর এক বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নিষেধাজ্ঞার সময়কালীন সাকিবের অনুপস্থিতি বাংলাদেশ দলের জন্য একটি কঠিন সময় ছিল। নিষেধাজ্ঞার সময়ে তিনি মোট ১৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ মিস করেন, যার মধ্যে ছিল ৪টি টেস্ট, ৩টি ওয়ানডে এবং ৭টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ।
করোনা মহামারীর প্রভাবে বিশ্বজুড়ে স্থগিত হওয়া ক্রিকেট কার্যক্রম সাকিবের নিষেধাজ্ঞার সময়কালকে প্রভাবিত করে। এই সময়ে, স্কুল ক্রিকেট থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে খেলা সাকিব আল হাসান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও সবসময় বাংলাদেশ ক্রিকেটকে সমর্থন করেছেন এবং নিজের ফিটনেস বজায় রেখে আবার ফিরতে প্রস্তুত ছিলেন।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সাকিব আল হাসান নিষেধাজ্ঞা শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করেন এবং আবারো সেরা ফর্মে খেলার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। তাঁর প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে আসে এবং তিনি সাল্ফেরী পারফরমেন্স দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেন। এই সময়ে তিনি টি-টোয়েন্টি ও অন্যান্য ফরম্যাটে দারুণ খেলেন এবং দলে তার স্থান পুনরুদ্ধার করেন। সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞা এবং প্রত্যাবর্তনের কাহিনী সত্যিই প্রমাণ করে যে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ে সব সম্ভব।