সুনীল শেট্টি
সুনীল শেট্টি, একজন বিশিষ্ট ভারতীয় অভিনেতা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক, তার দীর্ঘ ও সফল ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনার কোনও শেষ নেই। তার অসাধারণ প্রতিভা এবং অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন। সুনীল শেট্টি জীবনী নিয়ে আলোচনায় সবসময়ই উঠে আসে তার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের গল্প।
সুনীল শেট্টি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৯২ সালে চলচ্চিত্র “বলবান” দিয়ে, এবং তারপর থেকে তিনি নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকেও বলিউডে নিজের স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। সুনীল শেট্টির চলচ্চিত্র জগতে অবদান এবং তার ব্যবসায়িক উদ্যোগ সবমিলিয়ে তাকে ভারতীয় সিনেমার এক অমূল্য রত্নে পরিণত করেছে।
প্রাথমিক জীবন
সুনীল শেট্টির জন্ম ১৯৬১ সালের ১১ আগস্ট ভারতের ম্যাঙ্গালোরে এক তুলুভাষী বুন্ট পরিবারে। তার পারিবারিক পটভূমি তার সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে।
জন্ম এবং পরিবার
সুনীল শেট্টির জন্ম একটি তুলুভাষী পরিবারে, যা তার জীবন ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সুনীল শেট্টি জন্ম নেন ম্যাঙ্গালোরে। তার পরিবার তার প্রতি সমর্থন এবং ভালোবাসার প্রধান উৎস।
তুলুভাষী পরিবার
সুনীল শেট্টি পরিবার একটি প্রাচীন তুলুভাষী বুন্ট পরিবার। তিনি তার শৈশবে সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি গভীর সম্মান পোষণ করতেন। এ প্রভাব তার ব্যক্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ম্যাঙ্গালোরে বেড়ে ওঠা
ম্যাঙ্গালোরে সুনীল শেট্টি তার শৈশব কাটিয়েছেন। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তার বেড়ে ওঠায় অনন্য ভূমিকা রেখেছে। ম্যাঙ্গালোরে সুনীল শেট্টি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তার শৈশবকালের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, যা তার ব্যক্তিত্ব গঠন করেছে।
ক্যারিয়ারের শুরু
সুনীল শেট্টি অভিষেক হয়েছিল ১৯৯২ সালে, যখন তিনি “বলবান” সিনেমা দিয়ে বলিউডে তার যাত্রা শুরু করেন। এই সময় সুনীল শেট্টি প্রধানত অ্যাকশন ধাঁচের চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন যা তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তার কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি নিজের স্থান পাকা করে নিয়েছিলেন।
প্রথম চলচ্চিত্র বলবান
সুনীল শেট্টির প্রথম চলচ্চিত্র ছিল “বলবান”। এই সিনেমাটি নব্বইয়ের দশকের সুনীল শেট্টির জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বলবান সিনেমা তার ক্যারিয়ারের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। অ্যাকশন এবং রোমাঞ্চকর দৃশ্যাবলীতে ভরপুর এই সিনেমাটি তাকে বলিউডের হার্টথ্রবে পরিণত করেছিল।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিক
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে সুনীল শেট্টি অভিষেকের পর রোমাঞ্চকর এবং অ্যাকশান পারফরম্যান্সের জন্য দ্রুত বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তার অনবদ্য অভিনয় দক্ষতা এবং ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের প্রিয় নায়কে পরিণত হন। নব্বইয়ের দশক সুনীল শেট্টির কর্মজীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলেছিল, যা তাকে দীর্ঘমেয়াদী সফলতার পথে নিয়ে গিয়েছিল।
শীর্ষ চলচ্চিত্রসমূহ
সুনীল শেট্টি তার বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেছেন। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে “ধড়কন”, “হেরা ফেরি”, “বর্ডার”, এবং “ম্যায় হুঁ না” পরিলক্ষিত।
ধড়কন
২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “ধড়কন” চলচ্চিত্রটি সুনীল শেট্টির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল। এতে তার অভিনয় দেখে দর্শকেরা মুগ্ধ হয়। ধড়কন সুনীল শেট্টিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। এটি তার ক্যারিয়ারে একটি বিশাল মাইলফলক হিসেবে থেকে যাবে।
হেরা ফেরি
“হেরা ফেরি” সুনীল শেট্টির কমেডি প্রতিভার উদাহরণ হিসাবে বিবেচিত হয়। এই হিট চলচ্চিত্রে তিনি অক্ষয় কুমার এবং পরেশ রাওয়ালের সঙ্গে অভিনয় করে দর্শকদের হাসির হররা উপহার দেন। আরও উল্লেখযোগ্য যে, হেরা ফেরি চলচ্চিত্রটিতে তার কমেডি সময়ক্ষেপণ বিশ্বমানের।
বর্ডার
১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “বর্ডার” মুভিতে সমর চেতনা এবং দেশপ্রেমের মিশেলে একটি শক্তিশালী চিত্র তুলে ধরেন। বর্ডার মুভিটি বলিউডের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র হিসাবে বরেণ্য। এই চলচ্চিত্রের সফলতা সুনীল শেট্টির ক্যারিয়ারে নতুন মাত্রা যোগ করে।
ম্যায় হুঁ না
২০০৪ সালে “ম্যায় হুঁ না” চলচ্চিত্রে সুনীল শেট্টির নেতিবাচক চরিত্রটি বেশ নজরকাড়া ছিল। এটি তার পরিণত এবং শক্তিশালী অভিনয়ের উদাহরণ। ম্যায় হুঁ না চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রটি দর্শকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল এবং সেই কারণে তার অভিনয় প্রতিভা আরো পরিস্ফুটিত হয়েছে।
প্রযোজনা কর্মসূচি
সুনীল শেট্টি প্রযোজনায় সফলতার একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেন, যখন তিনি পপকর্ণ এন্টারটেইনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড নামে নিজের প্রযোজনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
এই সংস্থার অধীনে, তিনি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন যা চলচ্চিত্র প্রেমীদের মনে একটি স্থায়ী ছাপ ফেলেছে।
- খেল: এই অ্যাকশন-থ্রিলার চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ছবির কাহিনী এবং অভিনয় দর্শকদের মন জয় করে।
- রক্ত: এই রহস্য, রোমাঞ্চ ও নাটকীয় চলচ্চিত্রটি তার প্রযোজনা সংস্থার একটি পরিচিত সিনেমা। এর আকর্ষণীয় কাহিনী এবং শক্তিশালী অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল।
- ভাগম ভাগ: সুনীল শেট্টি প্রযোজনা সংস্থার এই কমেডি চলচ্চিত্রটি দর্শকদের হাসির ফোয়ারা এনে দেয়।
সুনীল শেট্টি প্রযোজনা বিভিন্ন ধরণের সিনেমা উপহার দেওয়ার মাধ্যমে বলিউডে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে। তার সংস্থার অধীনে আরও অনেক সৃজনশীল এবং বাণিজ্যিকভাবে সফল চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়ার ভবিষ্যৎ আশা করা যায়। পপকর্ণ এন্টারটেইনমেন্ট, ক্রমান্বয়ে তার প্রযোজনা কর্মসূচির মাধ্যমে মানসম্মত বিনোদন প্রদান করে চলেছে।
টেলিভিশন ক্যারিয়ার
সুনীল শেট্টি শুধু চলচ্চিত্র জগতেই নয়, টেলিভিশনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছেন। তাঁর টেলিভিশন ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য অংশ হলো বিভিন্ন রিয়েলিটি শো সঞ্চালনা।
সাহারা ওয়ানে বিগেস্ট লুজার জিতেগা
২০০৭ সালে, সুনীল শেট্টি সাহারা ওয়ান চ্যানেলের জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো বিগেস্ট লুজার জিতেগা সঞ্চালনা করেন। এই শোটি মূলত ওজন হ্রাস ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। সুনীল টেলিভিশন শোতে সুফল দিয়েছিল এবং সেই সময় প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
& টিভিতে আসল চ্যাম্পিয়ন
টেলিভিশন শো সঞ্চালক হিসেবে তাঁর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আসল চ্যাম্পিয়ন হাই দম?। এই শোটি ২০১৭ সালে & টিভিতে প্রচারিত হয়। আসল চ্যাম্পিয়নে, প্রতিযোগীদের বিভিন্ন শারীরিক চ্যালেঞ্জ পার করতে হতো, যেখানে সুনীল শেট্টি তাদের প্রেরণায় উজ্জীবিত করতেন। সুনীল টেলিভিশন মাধ্যমে এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন ধারা সঞ্চালনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
টেলিভিশনে তাঁর এই অসাধারণ অবদানের মাধ্যমে, তিনি প্রমাণ করেছেন যে তার প্রতিভা অবিরাম এবং বলিউডের বাইরেও তাঁর আলাদা একটি পরিচিতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। সাহারা ওয়ান এবং & টিভির এই শোগুলোতে সঞ্চালনা করার মধ্য দিয়ে সুনীল শেট্টি নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন।
ব্যবসা উদ্যোগ
সুনীল শেট্টি শুধুমাত্র একজন সফল অভিনেতা নন, তিনি একজন উদ্যোগপতি হিসেবেও সুপ্রতিষ্ঠিত। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাইরে তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগে নিজেকে বিলিয়েছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল সুনীল শেট্টি রেস্টুরেন্ট এবং সুনীল শেট্টি ফার্নিচার ব্যবসা।
রেস্টুরেন্ট ও বার
সুনীল শেট্টি ‘মিসচিফ ডাইনিং বার’ এবং ‘ক্লাব H2O’ নামে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মালিক। মুম্বাইতে অবস্থিত এই রেস্টুরেন্ট এবং বারগুলি তাদের সুস্বাদু খাবার ও বিনোদনের জন্য জনপ্রিয়। সুনীল শেট্টি রেস্টুরেন্ট ধারণাটি শুধুমাত্র খাদ্যপ্রেমীদেরই নয়, বিনোদনপ্রেমীদেরও আকৃষ্ট করে।
ফার্নিচার ও লাক্সারি স্টোর
সুনীল শেট্টি ফার্নিচার ব্যবসায়ও তার দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। তিনি ‘R House’ নামে একটি লাক্সারি ফার্নিচার এবং হোম লাইফস্টাইল স্টোর চালু করেছেন যেখানে বিভিন্ন রকমের উচ্চমানের ফার্নিচার পাওয়া যায়। এই স্টোরটি বিশেষত তাদের জন্য যারা আধুনিক ডিজাইন এবং উন্নতমানের উপকরণের সম্পূর্ণ মিলনী চান।
পারিবারিক জীবন
সুনীল শেট্টির পরিবার তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ১৯৯১ সালে, তিনি মানা শেঠীকে বিবাহ করেন। মানা শেঠী একজন সফল ব্যবসায়ী, ডিজাইনার এবং সক্রিয় সামাজিক কর্মী। সুনীল শেট্টি পরিবার এবং মানা শেঠীর যুক্ত উদ্যোগ তাদের সমাজসেবামূলক কাজের জন্য সুপরিচিত।
স্ত্রী এবং সন্তান
সুনীল শেট্টি এবং মানা শেত্টীর দুই সন্তান আছে: আথিয়া শেট্টি এবং অহন শেট্টি। আথিয়া শেট্টি অভিনয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন এবং বলিউডে বেশ কিছু সফল ছবিতে কাজ করেছেন। অন্যদিকে, ছেলে অহন শেট্টি ও অভিনয়ে পা রেখেছে এবং তাড়াতাড়ি বলিউডে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।
মেয়ে আথিয়া শেট্টি
আথিয়া শেট্টি তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘হিরো’ তে অভিনয় করেন এবং তারপর থেকে নানা রোম্যান্টিক ও ড্রামা ছবিতে কাজ করেছেন। আথিয়া শেট্টি ইতিমধ্যে তার অভিনয় দক্ষতায় বলিউডে নিজের জায়গা পাকা করেছেন এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।
ছেলে অহন শেট্টি
অহন শেট্টি তার অভিনয় জীবনের সূচনা ‘তড়াপ’ চলচ্চিত্র দিয়ে করেন এবং দ্রুতই দর্শকদের মন জয় করে নেন। সুনীল শেট্টির পুত্র হিসেবে নয়, বরং নিজস্ব প্রতিভা দিয়ে অহন শেট্টি বলিউডে নিজের পরিচিতি তৈরি করেছেন।