হার্ট অ্যাটাক এর লক্ষণ

হৃদযন্ত্রের সুচারু ক্রিয়া ব্যাহত হলে এবং পর্যাপ্ত রক্ত সঞ্চালন না হলে, হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা ঘটে থাকে, যা বিশ্বব্যাপী অগণিত মৃত্যুর কারণ। ডা. হিমেল সাহা বলেন, “হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক সংকেত অবজ্ঞা করা হলে অথবা সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পেলে এটি জীবন-ঘাতী পরিণতি হতে পারে।” তাই হার্ট ফেইলিউরের লক্ষণগুলি জানা এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

হার্ট অ্যাটাকের অনেকগুলো লক্ষণ রয়েছে যা প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত করা সম্ভব। হৃদরোগের উপসর্গ হিসেবে বুকে ব্যথা বা বুকের অস্বস্তি প্রধান। কখনো কখনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, বিশেষত বাম হাতে ব্যথা বা ব্যথার অনুভূতি দেখা যেতে পারে। শ্বাস কষ্ট এবং পীঠে অস্বস্তি অন্যান্য সচরাচর উপসর্গ। এই সমস্যাগুলির প্রতি অবহেলা না করে এবং সুস্থ জীবনযাপনের অভ্যাস গ্রহণ করে অগ্রিম পরিচর্যা করা গুরুত্বপূর্ণ।

হার্ট অ্যাটাক কি?

হার্ট অ্যাটাক, যা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন নামেও পরিচিত, হল এক ধরণের হৃদযন্ত্রের আকস্মিক ব্যর্থতা। এটি ঘটে যখন হৃদযন্ত্রে রক্তের প্রবাহ হঠাৎ করে ব্যাহত হয়, যা সাধারণত করোনারি ধমনীতে চর্বির জমাট বাঁধা বা রক্তকণিকার চাপের কারণে ঘটে। এতে হৃদযন্ত্রের কোষগুলি অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মারা যায়।

হার্ট অ্যাটাক এর কারণ

  • ধূমপান, যা ধমনীর দেয়ালকে দুর্বল করে
  • উচ্চ রক্তচাপ যা হৃদযন্ত্রের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে
  • উচ্চ কোলেস্টেরল, যা ধমনী পথে চর্বি জমাট বাঁধার সাথে সাথে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে
  • মদ্যপান ও অতিরিক্ত ওজন, যা হৃদযন্ত্রের গতিবিধির উপর প্রভাব ফেলে

হার্ট অ্যাটাক এর ধরন

হার্ট অ্যাটাকের বিভিন্ন ধরন রয়েছে, যেমন:

  1. এসটিইএমআই (ST-Elevation Myocardial Infarction): এই ধরনের হার্ট অ্যাটাকে হৃদযন্ত্রের এক বা একাধিক ধমনী সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
  2. এনএসটিইএমআই (Non-ST Elevation Myocardial Infarction): এক ধরনের হার্ট অ্যাটাক যেখানে ধমনী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না হলেও রক্তপ্রবাহ ক্ষীণ হয়।
আরও পড়ুনঃ  বাম চোখ লাফালে কি হয়?

হার্ট অ্যাটাকের ধরনের উপর যথাযথ চিকিৎসা নির্ভর করে। প্রাথমিক চিকিৎসায় অ্যাঙ্গিওপ্লাস্টি এবং স্টেন্টিং প্রচলিত।

প্রাথমিক লক্ষণ

হার্ট অ্যাটাকের প্রথমতম লক্ষণ সাধারণত হৃদযন্ত্রের অস্বস্তিবুকে পীড়া দ্বারা পরিলক্ষিত হয়, যা অবশ্যই সতর্কবার্তা হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।

বুকের ব্যথা

বুকের মাঝখানে কিংবা বাম দিকে হঠাৎ একটি চাপ অনুভূত হয়, যা অনেক সময় অবর্ণনীয়ভাবে তীব্র হতে পারে। এই রকম হার্ট অ্যাটাকের প্রথম সংকেত হয়ে থাকে যা বাজের সমন্বিত প্রতীকি সংকেত হিসেবে বিবেচিত। বুকে পীড়া হল এর একটি প্রধান লক্ষণ যা অন্যান্য প্রধান শারীরিক অংশের দিকে ব্যথার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে পারে।

শ্বাসকষ্ট

হার্ট অ্যাটাকের দ্বিতীয়তম প্রথম সংকেত হলো শ্বাসকষ্ট। এটি সাধারণত বুকের ব্যথার সাথে হয়ে থাকে, এবং এর জন্য অবশ্যই অতিসত্তর ব্যবস্তাগ্রহণ প্রয়োজন। শ্বাসকষ্ট প্রায়শই হৃদযন্ত্রের অস্বস্তির কারণেই সৃষ্টি হয় যা অক্সিজেনের ঘাতকতা দ্বারা সৃষ্ট।

  • হৃদযন্ত্রের এই অস্বাভাবিক অস্বস্তি প্রায় সময়ে বুকে পীড়ার সাথে যুক্ত হয়।
  • আকস্মিকতায় আসা এই লক্ষণগুলিকে অবহেলা করা উচিত নয় এবং দ্রুত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাওয়া উচিত।

উপরোক্ত প্রাথমিক লক্ষণগুলি যদি দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের সহায়তা নেওয়া জরুরি। প্রথম ঘণ্টাটি হৃদরোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল সময় হিসেবে পরিগণিত হয়, যাকে অনেক সময় ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলা হয়।

শারীরিক অঙ্গগুলোর লক্ষণ

হার্ট অ্যাটাকের শারীরিক লক্ষণ খুবই কঠিন এবং প্রায়শই অস্পষ্ট হয়। এর মধ্যে প্রমুখ হলরোগীর অঙ্গ ব্যথা যা বিভিন্ন অঙ্গে প্রকাশ পেতে পারে।

বাহুতে ব্যথা

হার্ট অ্যাটাকের সময় বাম বাহুতে হৃদযন্ত্র জ্বালা ও ব্যথা অনুভূত হয়। এই ব্যথা কখনও কখনও হাত অথবা কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়।

জ্বালা

হৃদযন্ত্রের জ্বালা সাধারণত বুকের ভেতরে একটি পোড়ানো অনুভূতির মতো প্রকাশ পায়, যা অন্যান্য অংশেও বিস্তৃত হতে পারে।

পিঠের অসুস্থতা

পিঠের উপরের অংশে ব্যথা বা অস্বস্তি হার্ট অ্যাটাকের একটি সাধারণ লক্ষণ। এই ব্যথা তীক্ষ্ণ হতে পারে এবং পিঠের মাঝামাঝি অথবা নিচের দিকে ছড়িয়ে যেতে পারে।

  1. বয়স ৫০ পেরনোর আগেই হৃদরোগে ভুগে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
  2. ২০-৪০ বছর বয়সী তরুণ এবং তরুণী মানুষের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্তির হার বেশি।
  3. বিশ্বজুড়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বেড়েছে ওপর তুলনায় ৩২ শতাংশ।
  4. হৃদরোগের মূল কারণ মধ্যপ্রাচ্চিন জীবনযাত্রা, অনিয়ন্ত্রিত খাওয়া এবং শরীরচর্চার অব্যাহতি।

মানসিক লক্ষণ

হার্ট অ্যাটাকের সময় শারীরিক উপসর্গ ছাড়াও বেশ কিছু মানসিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যা প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। মানসিক অসস্থি, চিন্তা এবং উদ্বেগ এবং হার্ট অ্যাটাকের মানসিক প্রভাব এই লক্ষণগুলির মধ্যে প্রধান।

আরও পড়ুনঃ  টেস্টোস্টেরন এর স্বাভাবিক মাত্রা কত?

উদ্বেগ এবং অস্থিরতা

হার্ট অ্যাটাক ঘটার আগে অনেকে তীব্র উদ্বেগ এবং অস্থিরতা অনুভব করেন। এই চিন্তা এবং উদ্বেগ শুধু মনের ব্যাপার নয়, এটি শারীরিক উপসর্গের সাথে জড়িত। এমনকি বিশ্লেষকরা বলেন যে এই ধরনের মানসিক চাপ হার্টের সমস্যার জন্য একটি অগ্রগামী ইঙ্গিত হতে পারে।

দৃষ্টিজনিত সমস্যা

হার্ট অ্যাটাকের সময় অনেকে দৃষ্টিশক্তির হালকা সমস্যা লক্ষ্য করেন। এটি মূলত মানসিক চাপ এবং চিন্তা এবং উদ্বেগের ফলে ঘটে থাকে, যা চোখের চাপ বাড়িয়ে তোলে। এই মানসিক অসস্থি সাময়িক হলেও এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে।

এই ধরনের মানসিক লক্ষণগুলি চিনে নেওয়া এবং সচেতন থাকা খুব জরুরি। হার্ট অ্যাটাকের মানসিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এগুলি প্রায়ই অবহেলিত হয় এবং এর ফলে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

প্রচলিত ভুল ধারণা

হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কিত ভুল ধারণা ব্যবহারিক ভাবে কতটা বড় একটি বিষয় তা অনেকেই উপলব্ধি করেন না। একটি সাধারণ ধারণা হল, যারা তরুণ রয়েছেন এবং যাদের সক্রিয় জীবনযাত্রা রয়েছে, তারা মনে করেন যে তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি অনুপস্থিত।

আমি তরুণ, আমার হবে না

উপরিউক্ত মনোভাব দুঃখজনকভাবে সাধারণ এবং বিপদজনক। যদিও তরুণ বয়সে হার্ট অ্যাটাকের মিথ থাকে যে ঝুঁকি কম, এটা মোটেও সত্যি নয়। চিকিৎসাবিদরা বারবার দেখিয়েছেন যে হৃদরোগ যে কোনো বয়সে হতে পারে এবং এর প্রতিরোধ এবং সনাক্তকরণ অত্যন্ত জরুরি।

শরীরের চিহ্ন সম্পর্কে অবহেলা

অনেকেই শরীরের সূক্ষ্ম লক্ষণগুলি উপেক্ষা করে থাকেন, যা হৃদরোগের জন্য পূর্বসূচক হতে পারে। পেশীর ব্যথা, বুকে অস্বস্তি, অত্যধিক ক্লান্তি বা হালকা হৃদস্পন্দনগুলি হালকা অনুভূত হলেও, এগুলি হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। এই মতো লক্ষণগুলির প্রতি ভুল ধারণা এবং অবহেলা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত করতে পারে।

সবশেষে, সচেতন হওয়া এবং যে কোনো উদ্বেগজনক লক্ষণের প্রতি সঠিকভাবে সাড়া দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এটি শুধুমাত্র সময়মতো চিকিৎসা পাওয়ার জন্য নয়, বরং একটি সুন্দ এবং দীর্ঘজীবিত জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজন।

আরও পড়ুনঃ  পিরিয়ডের সময় টক খেলে কি হয়?

বিভিন্ন বয়সের মধ্যে লক্ষণ

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলি মানুষের বয়স এবং জেন্ডার অনুযায়ী ভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে। যেমন, হার্ট অ্যাটাকের বয়স ভিত্তিক লক্ষণ এবং জেন্ডার ভিন্নতা নির্ণয়ে সহায়ক হতে পারে চিকিৎসাক্ষেত্রে। তরুণ রোগীদের মধ্যে যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়, তা প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের তুলনায় ভিন্ন।

ছেলে-মেয়েদের লক্ষণ

  • ছেলেদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ সাধারণত বিশিষ্ট হয়, যেমন বাহুতে ব্যথা বা বুকে প্রচণ্ড চাপ।
  • মেয়েদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ অনেক সময় কম প্রকট হতে পারে, যেমন মাঝে মাঝে অস্বস্তি বা হলকা বুকে ব্যথা।

বয়স্কদের লক্ষণ

  • বয়স্ক রোগীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের সাধারণ লক্ষণ হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা দ্বারা চিহ্নিত হতে পারে, যেমন প্রচুর ক্লান্তি বা সহাস্য দুর্বলতা।
  • অনেক ক্ষেত্রে, বয়স্কদের মধ্যে বুকে ব্যথার পরিবর্তে শ্বাসকষ্ট এবং বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা প্রাপ্তবয়স্ক রোগীরা এবং তরুণ রোগীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণভেদ সঠিকভাবে চিহ্নিত করার গুরুত্ব সম্পর্কে জোর দেন, যাতে যথাযথ চিকিৎসা সঠিক সময়ে নিশ্চিত করা যা�

মহিলাদ

মহিলাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। ৫৫ বছর বা তার বেশি বয়সের মহিলাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা প্রবণতা বেশি। তামাকের ব্যবহার, উচ্চ রক্তচাপ, ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগের ভয়ানক ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অধিকতর, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, এবং মেটাবলিক সিন্ড্রোম সহগামী ঝুঁকি বাড়ায়।

হার্ট অ্যাটাকের সময় মহিলাদের অনেক সময় প্রকাশিত লক্ষণগুলো পুরুষদের তুলনায় আলাদা। বুকের ব্যথা সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ হলেও, অন্যান্য সূক্ষ্ম উপসর্গ যেমন পেটের অস্বস্তি, অস্বাভাবিক ক্লান্তি বা উদ্বেগ অনুভূত হতে পারে। এসব উপসর্গ প্রায়ই অন্যান্য অসুস্থতার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয় যার ফলে জরুরি চিকিৎসা বিলম্বিত হয়ে পরিস্থিতি জটিলতর হয়ে উঠতে পারে।

তবে, সুখবর হলো, সচেতনতা এবং পরিবর্তনশীল জীবনধারা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। ধূমপান ছাড়া, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, এবং পুষ্টিকর আহারের মাধ্যমে মহিলারা হৃদরোগের ঝুঁকি কার্যকরীভাবে হ্রাস করতে সক্ষম। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মধ্যম মাত্রায় এরোবিক কার্যকলাপ হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক। সুতরাং, সাস্থ্যজনিত একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর জন্য আজই উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button