উত্তরা গণভবন
উত্তরা গণভবন, যা দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি নামেও পরিচিত, হল বাংলাদেশের নাটোর জেলার একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ। ১৮৩৯ সালে নির্মিত এই ভবনটি এখন জেলার অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ এবং একটি সরকারি ভবন হিসাবে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের রাজপ্রাসাদ হিসেবে এটি উত্তরাঞ্চলের গভর্মেন্ট হাউস নামে সুপরিচিত।
এই প্রাসাদটি দিঘাপতিয়া রাজবংশের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাথে জড়িত এবং এর নির্মাণশৈলী ও স্বতন্ত্র স্থাপত্য সকলকে মুগ্ধ করে। উত্তরা গণভবনের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক সামগ্রী যার মধ্যে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র অন্তর্ভুক্ত। এটি শুধু নাটোর নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
উত্তরা গণভবনের ইতিহাস
উত্তরা গণভবনের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বর্ণাঢ্য। এই প্রাসাদটি দিঘাপতিয়া রাজবংশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই রাজবংশের অবদান অবিস্মরণীয়।
দিঘাপতিয়া রাজবংশের সূচনা
দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম রায়, যিনি নাটোর রাজ্যের রাজা রাম জীবনের দেওয়ান ছিলেন, ১৬৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৩৪ সালে এই রাজবংশের প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। এই প্রাসাদটি উত্তরবঙ্গের উপজেলা নাটোর সদর এলাকায় অবস্থিত।
রাজাদের অবদান
দিঘাপতিয়া রাজবংশের রাজারা উত্তরা গণভবন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজাদের আওতায় বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান উন্নয়ন করা হয়েছিল এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
সংস্কার ও পরিবর্তন
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরা গণভবন নামকরণ করেন, যা দিঘাপতিয়া রাজবংশের ঐতিহাসিক পরিবর্তন প্রতিফলিত করে। এই প্রাসাদের একাধিক সংস্কার ও পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করে। সর্বশেষ সংস্কারের পর এটি বর্তমানে একটি পর্যটন আকর্ষণ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ
উত্তরা গণভবনের স্থাপত্যশৈলী মূলত ইন্দো-আরবীয় প্রভাবপূর্ণ যা নাটোরের ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মিত। এই ভবনের স্থাপত্য নকশা এবং নির্মাণশৈলী সম্পূর্ণরূপে সুনিপুণ এবং বহুমাত্রিক। এটি উত্তর বাংলার সাধনালিপির এক অপূর্ব উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মৌলিক ভবনের নকশা
প্রাথমিক ভবনের স্থাপত্য নকশা প্রাচীন রাজাশাহীর স্মারকগুলো থেকে অনুপ্রাণিত। দিঘাপতিয়া রাজবংশের স্থাপত্যের অতুলনীয় নিদর্শন এই ভবনের দেয়াল এবং খিলানের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে। ১৭৩৪ সালে নির্মিত এই স্থাপত্য নকশা সূক্ষ্ম কারুকাজে পূর্ণ এবং প্রতিটি কক্ষ ও প্রাসাদ-সমূহের নকশা সমৃদ্ধ স্থাপনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
পিরামিডাকৃতির প্রবেশ দ্বার
উত্তরা গণভবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান পিরামিডাকৃতির প্রবেশ দ্বার। এই প্রবেশ দ্বারটির উপরে একটি ঘড়িঘর রয়েছে যা ইতালি থেকে আমদানী করা গোলাকার ঘড়ি দিয়ে সাজানো হয়েছে। এটি ১৮ শতকের একটি সুন্দর উৎকৃষ্ট স্থাপত্য নিদর্শন।
প্রাসাদের বারান্দা ও প্লাস্টারের কাজ
ইন্দো-আরবীয় স্থাপত্যের আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো উত্তরা গণভবনের বারান্দা ও প্লাস্টারের কাজ। রাজাশাহী আমলে নির্মিত এই প্রাসাদের বারান্দা ও প্লাস্টারের কাজ অত্যন্ত সুদৃঢ় এবং কারুকার্যপূর্ণ। এই অনন্য নির্মাণশৈলী নাটোরের ঐতিহ্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উত্তরা গণভবনের স্থাপত্যশৈলী এবং নির্মাণশৈলী সমৃদ্ধতার প্রতিফলন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের গর্বিত অংশ হিসেবে চিহ্নিত।
উত্তরা গণভবনের প্রাসাদসমূহ
উত্তরা গণভবন বাংলাদেশের উত্তরের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে খ্যাত। ঐতিহাসিক নকশা ও প্রাসাদ স্থাপত্যের জন্য এটি বিশেষভাবে পরিচিত।
মূল প্রাসাদ ভবন
উত্তরা গণভবনের মূল প্রাসাদ ভবন ১৭৬০ সালে দারাম রায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভবনটি প্রাসাদ স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যার মধ্যে রয়েছে রাজকীয় নকশা ও কারুকার্য। এখানে অনেক ঐতিহ্যবাহী ভবন রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
কুমার প্রাসাদ ও অন্যান্য ভবন
কুমার প্রাসাদ ও অন্যান্য ভবনগুলি ঐতিহাসিক দিঘাপতিয়া রাজবংশের স্মৃতি বহন করে। এই প্রাসাদগুলির রাজকীয় নকশা এবং প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী চোখে পড়ার মতো। মূল প্রাসাদ ভবনের পাশাপাশি এই কুমার প্রাসাদও বিরাট ভূমিকা পালন করে ঐতিহ্যবাহী ভবন হিসেবে।
মূল্যবান কাঠের দরজা-জানালা
উত্তরা গণভবনে মূল্যবান কাঠের দরজা ও জানালা বিশেষ আকর্ষণীয়। এই কাঠের কাজগুলি রাজকীয় নকশা এবং কারুকার্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ঐতিহ্যবাহী ভবনের একটি সুন্দর উদাহরণ হিসেবে এগুলি প্রাসাদ স্থাপত্য শৈলীর বিশেষত্ব তুলে ধরে।
উত্তরা গণভবনের বাগান ও ভাস্কর্য
উত্তরা গণভবনের বাগানগুলি দীর্ঘ প্রাচীন ঐতিহ্য এবং বাগানশৈলীর অনন্য উদাহরণ হিসেবে পরিচিত। এখানে বাগান এবং ভাস্কর্য শিল্পের একটি অসাধারণ সমন্বয় দেখা যায়, যা প্রাচীন বাগান নকশার সমৃদ্ধ ইতিহাসকে তুলে ধরে।
ফোয়ারাসহ সুদৃশ্য বাগান
উত্তরা গণভবনের বাগানগুলিতে বেশ কিছু ফোয়ারা এবং সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ রয়েছে যা এক নজরে মুগ্ধ করে। ফোয়ারার ছড়ানো নকশা এবং জলপ্রপাতের কলকল ধ্বনি বাগানশৈলীর অপূর্ব সৌন্দর্যকে আরও উন্নত করে। বাগানে একাধিক পুকুর রয়েছে, যেমন গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, যা স্থানটির প্রাচীন বাগান নকশাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
মার্বেল পাথরের নারীমূর্তি
বাগানে মার্বেল পাথরের নারীমূর্তির সৌন্দর্য অন্য এক পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এ ভাস্কর্য শিল্পের প্রতিচ্ছবি বাগানের নান্দনিকতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তারা, যেন অতীতের কোন অলিক কল্পনার জগৎ থেকে উঠে এসেছে, এমনই বাস্তব এবং জীবন্ত।
বিরল প্রজাতির নানা উদ্ভিদ
উত্তরা গণভবনের বাগানে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে, ইতালি থেকে আমদানী করা অসংখ্য গাছ এ বাগানশৈলীকে আরও উচ্চমার্গীয় করে তুলেছে। প্রতিটি গাছের পরিচর্যা বিশেষভাবে করা হয় যাতে সেগুলি তাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে পারে।
উত্তরা গণভবনের সাংস্কৃতিক মুল্য
উত্তরা গণভবন তার রাজসিক ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। ১৮শ শতকের (১৭৩৪) শুরুতে নির্মিত এই প্রাসাদটি ঐতিহাসিক রাজবংশ দিঘাপতিয়া রাজবংশের জমিদারি রাজত্বের অংশ। দিঘাপতিয়া পারগানা ছিল এই রাজবংশের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, যা রানি ভবানির মতো বিশেষ ব্যক্তিত্বদের দ্বারা উপহারস্বরূপ দান করা হয়।
উত্তরা গণভবনের জীবন্ত ঐতিহ্যকে আরও বৈচিত্র্যময় করেছে ২০১৮ সালের ৯ই মার্চ উত্তরা গণভবন জাদুঘর প্রতিষ্ঠা। মোহাম্মদ শফিউল আলম, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, এই জাদুঘর উদ্বোধন করেন। এখানে আজও দেখা যায় দিঘাপতিয়া রাজবংশের মূল স্থাপনাসমূহ এবং জীবনযাত্রার বহু চিহ্ন। জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রায় শতাধিক প্রকরণবাচক উপকরণ এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রত্যয়ন করছে।
উত্তরা গণভবন বর্তমানে ৪১.৫১ একর জমিতে অবস্থিত; এতে রয়েছে ১২টি বৃহৎ শিল্পসমৃদ্ধ ভবন, যা প্রাসাদের রাজসিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। এই অভিজাত প্রাসাদ ১৯৭২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বারা উত্তরবঙ্গের সরকারী বাসভবন হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
এই প্রাসাদটির সাংস্কৃতিক মুল্য তার নির্মাণশৈলী, ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এবং স্থানীয় ইতিহাসের সাথে গভীর সম্পর্কের জন্য অপরিসীম। এর রাজসিক ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মেলা মেলাতে উত্তরা গণভবন আজও আমাদের সামনে জীবন্ত ঐতিহ্য হিসেবে অবস্থান করছে।
ভ্রমণ সম্পর্কিত তথ…
উত্তরা গণভবনে ভ্রমণ একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা হতে পারে। নাটোর শহর থেকে প্রায় ২.৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই স্থাপত্য নিদর্শনটি বাংলাদেশ তথা রাজশাহী বিভাগের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থান। মূল প্রাসাদের পাশেই থাকা অন্যান্য ভবন যেমন রান্নাঘর, মোটর গ্যারেজ, চালকের আবাসন, স্টাফ কোয়ার্টার্স ও ট্রেজারি বিল্ডিং, সবই অসাধারণ কাঠের নিদর্শন।
উত্তরা গণভবনের কমপ্লেক্সটি প্রায় ১২টি ভবনের সমন্বয়ে গঠিত, যা সবই দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। বিশেষ করে মূল প্রাসাদ ভবনের ঝুল বারান্দা ও প্লাস্টারের কারুকাজে মোড়ানো বৃহৎ হলঘর ও গম্বুজটি আপনাকে মুগ্ধ করবে। এই প্রাসাদে আছে একটি ইতালিয়ান বাগান, যা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। এছাড়া এখানে অবস্থিত সংগ্রহশালা ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে শতাধিক মূল্যবান সামগ্রী ও অন্যান্য নিদর্শন প্রদর্শিত হয়।
এছাড়াও, উত্তরা গণভবন কমপ্লেক্সের ভেতরে ৬টি পুকুর রয়েছে; সেগুলি হলো গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, শ্যামসাগর, কাশারিপুকুর, কালিপুকুর এবং কেশ্তাজির পুকুর। এই পুকুরগুলি প্রাসাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তোলে। উত্তরা গণভবনের পুরো এলাকাটি দেখার জন্য আপনি দিনের বেশ কিছু সময় ধরে ভ্রমণ করতে পারেন, যা আপনাকে সমৃদ্ধ করবে।