শ্বেত রক্তকণিকা কমে গেলে কি হয়?

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যে কয়েকটি প্রধান উপাদানের উপর অধিষ্ঠিত, তার মধ্যে শ্বেত রক্তকণিকা অন্যতম। যখন শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে যায়, অর্থাৎ প্রতি ঘন মিটারে 500 কোষের নিচে চলে আসে, তখন একটি অবস্থা ঘটে যাকে আমরা নিউট্রোপিনিয়া বলে থাকি। এটি এক ধরনের ইমিউন ডিফিসিয়েন্সি যা শরীরকে মাত্রা অনুযায়ী রক্ষা করতে অক্ষম করে তোলে এবং তার মানে হল বাড়তি হেলথ রিস্ক

বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার চিকিৎসার পর শ্বেত রক্তকণিকা হ্রাস পাওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। ১০০.৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট অথবা তার চেয়ে উচ্চ জ্বর প্রায়ই নিউট্রোপিনিয়ায় ইনফেকশনের প্রথম নির্দেশক। সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করতে হাতের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং এটিএম, দরজার নব, ফোন, এলিভেটরের বোতাম, এবং কম্পিউটার কীবোর্ডের মতো পৃষ্ঠগুলির সাথে যোগাযোগের পর অ্যালকোহল ভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহারকে পরামর্শ দেওয়া হয়। সংক্রমণ প্রতিরোধের অন্যান্য পরামর্শে রয়েছে অসুস্থ ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকা, ভিড় এড়ানোর জন্য মুখোশ পরা এবং ডেন্টাল প্রসিডিউরগুলি বিষয়ে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীর সাথে আলোচনা করা।

Contents show

শ্বেত রক্তকণিকার ভূমিকা

শ্বেত রক্তকণিকা মানবদেহের ইমিউনিটিপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় রাখার এক অপরিহার্য উপাদান। এগুলি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই করে শরীরকে সংক্রমণ এবং বিভিন্ন রোগের থেকে রক্ষা করে।

শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূল কাজ হলো শরীরকে সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং টক্সিন থেকে সুরক্ষিত রাখা। শ্বেত রক্তকণিকা এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, যা ইনফেকশনকে প্রতিরোধ করার মাধ্যমে ইমিউনিটি বৃদ্ধি পায়।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

শ্বেত রক্তকণিকা শরীরের ইনফেকশন প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়ায় এবং নানা রকমের ইমিউন রেসপন্স উৎপাদনে সহায়তা করে। এই ক্ষমতা ভাইরাস এবং অন্যান্য মাইক্রোবায়াস প্রতিহত করার মাধ্যমে শরীরকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুনঃ  রক্তে SGPT বেড়ে গেলে কি হয়?

ইনফেকশন প্রতিরোধে

ইনফেকশন প্রতিরোধে শ্বেত রক্তকণিকার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কণিকাগুলি শরীরে প্রবেশ করা ব্যাধিগুলির ভাইটাল সাইন চিহ্নিত করে এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়, যাতে শরীর সঠিক প্রতিকার পায়।

শ্বেত রক্তকণিকা কমা কেন ঘটে?

শ্বেত রক্তকণিকা কমার প্রধান কতগুলি কারণ রয়েছে যা বিভিন্ন অসুস্থতা, মেডিকেল প্রক্রিয়া এবং পুষ্টির ঘাটতির সাথে সম্পর্কিত। এই কারণগুলির বুঝতে পেরে আমরা এর প্রতিকার খুঁজে বের করতে পারি।

অসুস্থতা এবং সংক্রমণ

বিভিন্ন ধরণের অসুস্থতা এবং সংক্রমণ, যেমন ভাইরাল বা ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন, শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করে দিতে পারে, যা শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা হ্রাস পায়।

চিকিৎসা এবং মেডিকেল প্রক্রিয়া

কেমোথেরাপি সহ কিছু মেডিকেল কন্ডিশন চিকিৎসা শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা কমিয়ে দেয়। এছাড়াও, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এই অবস্থা দেখা দিতে পারে।

খাদ্য এবং পুষ্টির অভাব

  • অপর্যাপ্ত পুষ্টির ঘাটতি রক্তের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে এবং শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা কমিয়ে দেয়।
  • প্রোটিন, ভিটামিন এবং মিনারেলের অভাবে শরীর সঠিকভাবে রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয় না।

এই বিষয়গুলি বুঝে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে শ্বেত রক্তকণিকা কমা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

শ্বেত রক্তকণিকার প্রকারভেদ

শ্বেত রক্তকণিকা, যাকে আমরা সাধারণত শ্বেতাণু বলে থাকি, তাদের মূল ভূমিকা হলো মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম সুরক্ষিত রাখা। এই শ্বেতাণুগুলো মূলত তিন ধরনের – নিউট্রোফিল, লিম্ফোসাইট এবং মনোসাইট। প্রত্যেকের একটি স্পেসিফিক কাজ রয়েছে যা তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পাদন করে থাকে।

নিউট্রোফিল

নিউট্রোফিল হলো শ্বেত রক্তকণিকার মধ্যে সবচেয়ে প্রচুর পরিমাণে উপস্থিত এবং তারা মূলত ব্যাকটেরিয়া এবং ফাঙ্গাসজনিত ইনফেকশনগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করে। যে কোনো প্রথমিক ইনফেকশনের সময় এদের সক্রিয়তা প্রথমে দেখা যায়।

লিম্ফোসাইট

লিম্ফোসাইট রক্তে এবং লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে বিরাজমান থাকে এবং এরা প্রধানত দুই ধরনের – T-কোষ এবং B-কোষ। T-কোষ শরীরের সেলুলার ইমিউনিটি সৃষ্টি করে এবং B-কোষ অ্যান্টিবডি-মেডিয়েটেড ইমিউনিটি তৈরি করে, যা সক্রিয় রোগজীবাণুগুলিকে নিরপেক্ষ করে। NK-কোষ সহজাত ইমিউন সিস্টেমের অংশ হিসেবে কাজ করে।

আরও পড়ুনঃ  ফ্যাটি লিভার কি ভালো হয়?

মনোসাইট

মনোসাইট বড় এবং দীর্ঘজীবী শ্বেত রক্তকণিকা যা টিস্যুতে প্রবেশ করে ম্যাক্রোফেজে পরিণত হয়। এগুলি ধীরগতির ইনফেকশন এবং গভীরতর ক্ষতির প্রতিরোধ করে এবং আক্রান্ত এলাকায় নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।

প্রত্যেক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা ইমিউন সিস্টেমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কাজ করে এবং শরীরকে নানান রোগজনক মাইক্রোঅর্গানিজম থেকে রক্ষা করে। এই বৈচিত্র্যময় কোষগুলির যথাযথ কার্যকারিতা শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।

শ্বেত রক্তকণিকা কমে গেলে লক্ষণ

শ্বেত রক্তকণিকা কমে গেলে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায়, যা প্রায়ই স্বাস্থ্য সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। এই লক্ষণগুলি সাধারণত একের অধিক রূপে প্রকাশিত হতে পারে, যেমন:

ক্লান্তি এবং দুর্বলতা

ক্লান্তি এবং সাধারণ দুর্বলতা মানুষের মধ্যে একটি প্রাথমিক এবং সাধারণ লক্ষণ। এটা ঘটে থাকে কারণ শরীরের প্রতিরক্ষা সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে শরীর সাধারণ কাজকর্ম করার জন্যও অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয়।

ঘন ঘন সংক্রমণ

ইনফেকশন প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে যাওয়া ঘন ঘন সংক্রমণের কারণ হতে পারে। বিশেষত ভাইরাস এবং জীবাণু সংক্রান্ত ইনফেকশনগুলি আরও প্রায়ই ঘটতে থাকে।

ত্বকের পরিবর্তন

ত্বকে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন যেমন র্যাশ, ঘা এবং অন্যান্য অস্বাভাবিক চিহ্ন দেখা দিতে পারে। এগুলি ত্বকের আরও বড় সমস্যার লক্ষণ হতে পারে, এবং তা ইনফেকশন প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবের ইঙ্গিত দেয়।

কিভাবে শ্বেত রক্তকণিকা বাড়ানো যায়?

শ্বেত রক্তকণিকা বাড়ানোর জন্য কিছু প্রাকৃতিক উপায় রয়েছে যা শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে ও অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা করতে সহায়ক।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

ভালো ডায়েট নেওয়া অপরিহার্য। খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এ, সি এবং ই, ফোলেট, আয়রন এবং দানা জাতীয় খাবার যোগ করা উচিত। রংচং ফল ও শাকসবজি, ডাল, লীলামোহন স্নায়ুবর্ধক খাবার যেমন বাদাম এবং বীজ শ্বেত রক্তকণিকা বাড়াতে সহায়ক।

নিয়মিত ব্যায়াম

নিয়মিত ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে বাড়িয়ে দেয়। এটি পরোক্ষভাবে শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদনকে বাড়িয়ে দেয়। সপ্তাহে অন্তত তিনদিন, প্রতিদিন 30 মিনিট হাঁটা, জগিং বা সাইক্লিং এর অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন।

পর্যাপ্ত বিশ্রাম

পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং ইমিউন সিস্টেমকে সচল রাখতে খুব জরুরি। প্রত্যেক রাতে অন্তত আট ঘন্টা ঘুম আপনার শরীরকে নতুন করে সাজাতে সাহায্য করে তাই ভালো ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন।

আরও পড়ুনঃ  প্রেগন্যান্ট হওয়ার কত দিন পর মাসিক বন্ধ হয়?

এই তিনটি চর্চার মাধ্যমে, আপনার শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়ানোর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে এবং শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

চিকিৎসা পদ্ধতি

ব্যক্তির স্বাস্থ্য অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রযোজ্য হয়। এর মধ্যে মেডিকেশন, ব্লাড ট্রান্সফিউশন, এবং ইমিউন থেরাপি অন্যতম।

ওষুধের ব্যবহার

ওষুধের মাধ্যমে অনেক সময়ে শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সংক্রমণের প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত হয়। গ্রানুলোসাইট উত্তেজক কারক (G-CSF) মেডিকেশন শ্বেত রক্তকণিকা সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়।

রক্তের ট্রান্সফিউশন

গুরুতর অবস্থায় ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে রোগীর শরীরে কৃত্রিম ভাবে শ্বেত রক্তকণিকা সরবরাহ করা হয়, যা প্রায়শই জীবন বাঁচাতে পারে।

ইমিউন থেরাপি

ইমিউন থেরাপি প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে আরো কার্যকরী করা হয়, যা বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ এবং রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম হয়। এই পদ্ধতি বিশেষ করে অন্যান্য চিকিৎসা ব্যর্থ হলে ব্যবহার করা হয়।

শ্বেত রক্তকণিকার উপর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য রক্ষার প্রথম ধাপ হিসেবে শ্বেত রক্তকণিকা অপরিহার্য। এর বিপাক ও সুস্থতা নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা ও পুষ্টি বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা তাদের গবেষণা-ভিত্তিক পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

ডাক্তারদের মতামত

স্বাভাবিকভাবে, পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪.৭ থেকে ৬.১ মিলিয়ন কোষ প্রতি মাইক্রোলিটার এবং মহিলাদের জন্য ৪.২ থেকে ৫.৪ মিলিয়ন কোষ এবং শিশুদের জন্য ৪.০ থেকে ৫.৫ মিলিয়ন কোষ মান বজায় রাখা জরুরি। এই পরিসীমা বয়স এবং লিঙ্গ অনুযায়ী ভিন্নতা প্রদর্শিত হয়ে থাকে, এবং এই পরিবর্তনগুলি গর্ভাবস্থা, থাইরয়েড জটিলতা, রক্তপাত, লিউকেমিয়া এবং পুষ্টর ঘাটতির কারনে ঘটতে পারে। সিবিসি পরীক্ষার মাধ্যমে এই মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব।

পুষ্টিবিদদের টিপস

পুষ্টিবিদগণ অবশ্যই পরামর্শ দেন যে নির্দিষ্ট খাবারগুলি, যেমন আয়রন, ভিটামিন বি১২ এবং ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার, শ্বেত রক্তকণিকা ও তার উৎপাদনে আবশ্যক হয়। আর্গানিক প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য, পাতি লেবু পানি ও হালকা ব্যায়াম মানব শরীরের হেল্‌থ উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ব্যক্তির পুষ্টির চাহিদা ভিন্ন হতে পারে বিধায় স্থায়ী পরীক্ষা ও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুসরণ উচিত।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button