হিসাববিজ্ঞান কাকে বলে?

প্রতিটি ব্যবসায়ের হৃৎপিন্ড বলা হয় হিসাববিজ্ঞানকে, যার ভূমিকা হলো আর্থিক তথ্য সংগ্রহ, রেকর্ডিং, পরিকল্পনা এবং বিশ্লেষণ করা। হিসাববিজ্ঞান সংজ্ঞা অনুযায়ী, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা একটি সংস্থা তার আর্থিক লেনদেনের তথ্য একত্রিত করে, বিশ্লেষণ এবং প্রতিবেদন করে, যাতে সংস্থাটির আয়, ব্যয় এবং লাভ বা লোকসানের পরিষ্কার ধারণা থাকে।

হিসাব রক্ষণ পদ্ধতি অর্থাৎ বুককিপিং হলো আর্থিক হিসাব বিজ্ঞানের মূল অংশ যেখানে দৈনিক আর্থিক লেনদেনগুলি যেমন আয়, ব্যয়, ক্রয়, বিক্রয়, প্রাপ্য এবং পরিশোধ্য রেকর্ড সঠিক এবং সুশৃঙ্খলভাবে বই বা সিস্টেমে রেকর্ড করা হয়। এর মাধ্যমে অডিটিং বা করের উদ্দেশ্যে নথি প্রস্তুতি এবং ফাইলিং প্রক্রিয়া সরলীকৃত হয়। এই হিসাববিজ্ঞানের পদ্ধতিসমূহ নিয়ে আমাদের নিবন্ধের পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলিতে একটি বিস্তারিত আলোচনা আছে।

হিসাববিজ্ঞানের সংজ্ঞা

হিসাববিজ্ঞান বলতে ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক আর্থিক ঘটনাগুলির সংগ্রহ, শ্রেণিবিন্যাস, সারাংশ এবং বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এর মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও নির্ভুল অর্থনৈতিক তথ্য প্রদান করা হয়, যা ব্যবসায়ের সাফল্য অনুমানে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপরিহার্য।

একটি হিসাববিজ্ঞানের পরিচিতি গড়ে ওঠে হিসাবের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ঘটনা এবং হিসাব শাস্ত্রের পরিভাষা অনুসরণ করে। এটি না কেবল ডাটা রেকর্ড করে, বরং সেগুলিকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করে যা কোম্পানির আর্থিক দিক থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

হিসাববিজ্ঞান কি?

হিসাববিজ্ঞান একটি পেশাদার শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয় যা আর্থিক লেনদেনকে সঠিকভাবে রেকর্ডিং, শ্রেণিবিন্যাস, এবং বিশ্লেষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। এই প্রক্রিয়া সাহায্য করে সংস্থাকে তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা বুঝতে এবং পরিকল্পনা তৈরি করতে।

হিসাববিজ্ঞানের গুরুত্ব

হিসাববিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি না শুধুমাত্র আর্থিক তথ্য সরবরাহ করে, বরং ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তগুলির জন্য একটি নিরপেক্ষ ভিত্তি প্রদান করে। আর্থিক লেনদেনের সঠিক রেকর্ড রাখা এবং সেগুলির উপর ভিত্তি করে প্রাসঙ্গিক তথ্য ্রদান করে এটি প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মকর্তাদের জন্য অপরিহার্য।

আরও পড়ুনঃ  ট্রানজেকশন আইডি কি?

সংক্ষেপে, হিসাববিজ্ঞান ব্যবসায়ের ভাষা হিসেবে কাজ করে এবং এটি একটি অনিবার্য উপাদান যা প্রতিটি ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য আবশ্যক। এটি ব্যবসায়িক উন্নয়ন ও সাফল্য অর্জনের অবশ্যম্ভাবী অংশ।

হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাস

হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিবর্তনের সমৃদ্ধ ইতিহাস আমাদের প্রাচীন সভ্যতায় পর্যন্ত ফিরে যায়। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর এবং ব্যাবিলনে এর অস্তিত্ব ছিল, যেখানে ব্যবসায়িক লেনদেন ও অর্থনৈতিক হিসাব নিরীক্ষণের প্রাথমিক পদ্ধতি বিকশিত হয়েছিল।

প্রাচীন যুগ থেকে শুরু

ঐতিহাসিক হিসাব শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে যে প্রাচীন যুগে ব্যবসায়ী ও বণিকরা নিজেদের সম্পদ ও লেনদেনের হিসেব রাখার জন্য নানা ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। এই সময় থেকেই হিসাববিজ্ঞানের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তি ঘটতে থাকে।

আধুনিক যুগের বিবর্তন

হিসাববিজ্ঞানের আধুনিক যুগের বিবর্তন প্রযুক্তি ও নতুন পদ্ধতির সমন্বয়ে ঘটে। এই সময়ে, আধুনিক হিসাববিজ্ঞান শাস্ত্র প্রবর্তন ঘটে, যা ১৯ শতকে শিল্প বিপ্লবের পর ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। বড় বড় কর্পোরেশন এবং সরকারকে সঠিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করার জন্য হিসাবশাস্ত্রীদের উপর বিশেষ নির্ভরতা শুরু হয়।

হিসাববিজ্ঞানের শাখাসমূহ

হিসাববিজ্ঞানের বহুমুখিনতা এর বিভিন্ন শাখাগুলোর মধ্যে প্রকাশ পায়, যা ব্যবসায়িক এবং আর্থিক বিশ্বের বিভিন্ন চাহিদাসমূহ পূরণ করতে সহায়ক।

আর্থিক হিসাব

আর্থিক হিসাব মৌলিক হিসাবশাস্ত্রের একটি প্রধান দিক। এটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবৃতি প্রণয়নের জন্য দায়ী, যা বিনিয়োগকারী ও ব্যবস্থাপনাকে সংগঠনের সম্পদ ও দায়িত্বের সঠিক চিত্র উপস্থাপন করে। আর্থিক হিসাবের লক্ষ্য হলো সংগঠনের আর্থিক অবস্থান, কার্যক্রমের ফলাফল এবং নগদ প্রবাহ সম্পর্কিত স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত তথ্য প্রদান করা।

ব্যবস্থাপনামূলক হিসাব

ব্যবস্থাপনামূলক হিসাব, যা ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং নামেও পরিচিত, প্রধানত ব্যবস্থাপনার সাহায্য করে তারা যেন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়ে ওঠে। এই শাখার উদ্দেশ্য হলো অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা যেমন মূল্য নির্ধারণ, বাজেট প্রনয়ন, ব্যয় বিশ্লেষণ এবং আর্থিক পরিকল্পনা সহায়তা করা। এই শাখা ব্যবসার কার্যকারিতা উন্নয়নে সহায়ক হন।

আরও পড়ুনঃ  ই কমার্স কি?

কর হিসাব

কর হিসাববিজ্ঞান বা ট্যাক্স অ্যাকাউন্টিং হলো হিসাববিজ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা কর সংক্রান্ত হিসাবের সঠিক নিরীক্ষণ ও পরিচালনা করে। এর মাধ্যমে ব্যবসা ও ব্যক্তির করের দায়িত্ব পরিচালনা, কর প্রদান ও সঠিক কর প্রতিবেদন নিশ্চিত করা হয়। এই শাখা আইনি প্রয়োজনীয়তাসমূহ মেনে চলা এবং কর সংক্রান্ত দায়িত্বগুলো বুঝতে সহায়তা করে।

হিসাববিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে?

হিসাববিজ্ঞান আর্থিক তথ্য ও লেনদেনের ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহণ, চিহ্নিতকরণ এবং পর্যালোচনার একটি প্রক্রিয়া। এবং প্রাচীন সময় থেকেই হিসাববিজ্ঞানের মূল কাজ হচ্ছে অর্থলিপি এবং তথ্য সংরক্ষণের পদ্ধতি উন্নত করা।

হিসাববিজ্ঞান প্রক্রিয়া

আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়:হিসাব চিহ্নিতকরণ, হিসাব লিপিবদ্ধীকরণ, এবং রি্র্পটিং প্রক্রিয়া। এই ধাপগুলি নিম্নরূপ:

  1. লেনদেন চিহ্নিতকরণ: সকল আর্থিক লেনদেন যাচাই ও নথিভুক্ত করা।
  2. হিসাব লিপিবদ্ধকরণ: ডাটা এন্ট্রি এবং লগ রাখার মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ।
  3. রিপোর্ট তৈরি এবং বিশ্লেষণ: আর্থিক রিপোর্ট সাজানো এবং বিশ্লেষণ সঞ্চালন।

হিসাববিজ্ঞানে ব্যবহৃত সরঞ্জাম

হিসাববিজ্ঞান প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল ও প্রচলিত দুই ধরণের উপকরণ ব্যবহার হয়। মূলত:

  • ডিজিটাল হিসাব প্রণালী: যেমন সফটওয়্যার, যা কোম্পানির আর্থিক তথ্যাবলি সঠিকভাবে বোঝার ও হিসাব রাখার কাজে অপরিহার্য।
  • প্রচলিত হিসাব খাতা ও ব্যালেন্স শীট: যা হাতে লেখা তথ্যাবলি ও মৌলিক হিসাব নিকাশে ব্যবহৃত হয়।

সমগ্র হিসাববিজ্ঞানের প্রণীত প্রক্রিয়া ও সামগ্রিক প্রাপ্তি হিসাবে, হিসাববিজ্ঞান অর্থনৈতিক তথ্যের গভীর বোঝার এবং সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তি সরবরাহ করে। যা কোম্পানির হিসাববিজ্ঞানের মূল কাজ হিসেবে গণ্য হয়।

হিসাববিজ্ঞানের মূলনীতি

হিসাববিজ্ঞানের মূলনীতিগুলো ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এই নীতিমালাগুলি সঠিক এবং যথাযথ আর্থিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনাকে সহায়তা করে।

দ্বৈত পদ্ধতি

দ্বৈত এন্ট্রি সিস্টেম হলো অ্যাকাউন্টিং ফান্ডামেন্টালসের একটি প্রধান উপাদান যেখানে প্রতিটি লেনদেন দ্বৈতভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। এটি এক দিকে খরচ এবং অপর দিকে আয় হিসাবে প্রতিফলিত হয়।

  • প্রতিটি রাজস্ব লেনদেনের ক্ষেত্রে পাওনা এবং দেনা হিসেবের বিবরণ থাকে।
  • ব্যবসার সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা নির্ধারণে এই পদ্ধতি অপরিহার্য।
  • এটি ৭ নম্বরে অ্যাকাউন্টিং নীতির অন্তর্ভুক্ত।
আরও পড়ুনঃ  ট্রেডিং কি?

সহায়ক নীতিমালা

অ্যাকাউন্টিং ফান্ডামেন্টালস মেনে চলার জন্য সহায়ক নীতিমালাগুলো ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টিং প্রক্রিয়ার গুণগত মান উন্নত করে। এগুলি নিম্নরূপ:

  1. মেলেমানানো নীতি: খরচ এবং রাজস্ব সঠিকভাবে মিলিত হওয়া উচিত।
  2. ঐতিহাসিক খরচের ধরন: অর্থ ব্যয়ের ঐতিহাসিক মূল্য ব্যবহার করা।
  3. রাজস্ব সনাক্তকরণ: আয়ের সঠিক সময় নির্ধারণ করা।
  4. এই নীতিমালাগুলো দ্বৈত এন্ট্রি সিস্টেমের সাথে মিলে প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে।

সঠিকভাবে অ্যাকাউন্টিং ফান্ডামেন্টালসদ্বৈত এন্ট্রি সিস্টেম অনুসরণ করে ব্যবস্থাপনা তার লক্ষ্যগুলি অর্জনের পথে অগ্রসর হতে পারে। এই মৌলিক নীতিগুলো আর্থিক রিপোর্টিংয়ের গুণমান নিশ্চিত করে এবং ব্যবসায়ের প্রাথমিক পরিচালনা তথাকথিত দূরদর্শী সিদ্ধান্তগুলির জন্য ভাল মানের প্রমাণ প্রদান করে থাকে।

হিসাববিজ্ঞানের উপকারিতা

হিসাববিজ্ঞান হচ্ছে ব্যবসায়িক পরিচলনার মেরুদণ্ড, যা ব্যবসায়ের পরিচালনা, আর্থিক নির্ণয়, এবং সামগ্রিক কার্যক্রম সম্পাদনে অনিবার্য ভূমিকা রাখে। হিসাবের সঠিকতাব্যবসায়ের আর্থিক সঠিকতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে, হিসাববিজ্ঞান আমাদের ব্যবসায়িক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশে সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ব্যবসায়িক দৃঢ়তা

ঐতিহাসিক এবং আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের পার্থক্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে, আজকের হিসাববিজ্ঞান পদ্ধতি ব্যবসার পাঁচটি মৌলিক হিসাবের শাখা – সম্পদ (Asset), দায় (Liability), মালিকের ইকুইটি (Owner’s Equity), আয় (Revenue), এবং ব্যয় (Expense) অ্যাকাউন্টগুলো ধারণ করে। এই হিসাবগুলো বিভিন্ন সম্পদ যেমন নগদ, ব্যাংক ব্যালান্স, জায়, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির ট্র্যাক রাখে, যা ব্যবসায়িক দৃঢ়তার ভিত্তি সরবরাহ করে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের সহায়তা

ভালো এবং কার্যকর হিসাববিজ্ঞানের যথাসম্ভব সঠিক প্রযুক্তিগত উপায়ের প্রয়োগ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপরিমাপের সহায়ক হয়ে উঠেছে। হিসাবের এই অপরিহার্য শাখাগুলি, যেমন ব্যবসার পরিচালনা, আয়, এবং ব্যয়, হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত তৈরিতে প্রবলভাবে অবদান রাখে। এই পদ্ধতি ব্যবসার আর্থিক আচরণ ও সাফল্যের পূর্বাভাস দিতে সাহায্য করে, যাতে করে ব্যবসায়িক উন্নতি ও বিকাশ নিশ্চিত হয়।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button