যৌতুক কি? বিয়ের অপ্রচলিত প্রথা

সমাজের দীর্ঘকালীন অনুষঙ্গ হিসেবে, যৌতুক প্রথা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে প্রচলিত, যা বিয়ের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। এর মাধ্যমে পাত্র বা পাত্রীর পক্ষ থেকে অর্থ, জমি বা অন্য সম্পদের রূপে উপহার দেয়া হয়। বিয়ে ও যৌতুক এর যোগসূত্র অনেক সময় নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

যৌতুকের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি বহু প্রজন্ম ধরে অনেক সংস্কার ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। যদিও এই প্রথাটি সমাজের অনেক অঞ্চলে এখনো বহাল আছে, তবুও যৌতুক নির্মূল নিয়ে ব্যাপক পদক্ষেপ ও আইনি উদ্যোগ চালু হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতি ও নারীর সম্মানজনক স্থান নিশ্চিত করতে, যৌতুকের প্রচলনের পরিবর্তে শিক্ষা ও সমতার উপর জোর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

Contents show

যৌতুকের ইতিহাস ও বিকাশ

বিলকিস রহমানের “উনিশ শতকে বাংলায় নারী পুরুষ সম্পর্ক” বইটি, প্রাচীন যৌতুক প্রথার গভীর উপস্থিতি এবং বাংলাদেশের সমাজে যৌতুকের সূচনা-র ঐতিহাসিক প্রবাহ বর্ণনা করে। বইটি দেখায় যে, ঐতিহ্যগতভাবে যৌতুক শুধুমাত্র সামাজিক লেনদেন নয়, বরং সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতীক হিসাবে কাজ করে।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যে যৌতুকের স্থান

যৌতুকবহুল প্রথা বহু শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের বিবাহ সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। বাংলাদেশে প্রাচীন যৌতুক প্রথার অংশ হিসেবে কনের পরিবার থেকে বরের পরিবারে বিবাহের সামগ্রী ও অর্থের প্রদানের রীতি বর্তমান। এই প্রথা আজও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সম্পর্কের সহায়ক হয়ে ওঠে, যদিও তা নানা সমালোচনা ও সংকটের মুখোমুখি।

অন্যান্য সংস্কৃতিতে যৌতুকের উদাহরণ

বাংলাদেশের বাইরে, অন্যান্য সমাজ ও সংস্কৃতিতেও যৌতুক প্রথা যৌতুকের সূচনা হিসেবে প্রচলিত, যা ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং বলকানের সমাজগুলিতে রীতিনীতি ও পারিবারিক মর্যাদা বজায় রাখার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই প্রথানুযায়ী, বিয়ের সময় কনের পরিবার কিছু নির্দিষ্ট অর্থ বা মূল্যবান সামগ্রী বরের পরিবারকে প্রদান করে থাকে। এই রীতি সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃতি লাভ করেছে, এবং যদিও এর সামাজিক এবং আর্থিক প্রভাব প্রশ্নবিদ্ধ, তথাপি এটি নিয়মিত প্রচলিত থাকে।

আরও পড়ুনঃ  মানি লন্ডারিং কি? সহজ ব্যাখ্যা

যৌতুকের সামাজিক প্রভাব

বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইস্যু যা অনেক সামাজিক অবস্থার উন্মোচন করে। এটি যৌতুক প্রথা ফলাফলসমূহের একটি স্পষ্ট নিদর্শন যেখানে এর আশ্রয়ে বহু বিদ্ঘুঁটে সমস্যা জড়িত। যৌতুকের সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণে আমরা বিবিধ পার্থক্য লক্ষ করতে পারি, যা পরবর্তী দুইটি হেডিংসে আলোকপাত করা হবে।

যৌতুকের কারণে সামাজিক অবস্থা

যৌতুকের প্রভাবে বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত। সিআইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেক নারী যৌতুক জনিত কারণে শারীরিক ও মানসিক হিংসার শিকার হয়েছে। এই প্রথার অনুসরণে পরিবারগুলির উপর অর্থনৈতিক চাপ ও ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অবশ্যই সামগ্রিক সামাজিক অবস্থাকে নেগেটিভলি প্রভাবিত করছে।

যৌতুকের ফলে সুবিধা ও অসুবিধা

  1. সুবিধা: যদিও যৌতুক প্রথা অনেক অসুবিধা বয়ে আনে, কতিপয় ক্ষেত্রে এটি পরিবারের মর্যাদা ও সামাজিক স্থান বৃদ্ধি করে, কিন্তু এটা যে বৈষম্যমূলক এবং অন্যায্য তা স্বীকার করা দরকার।
  2. অসুবিধা: যৌতুক প্রথার ফলে অনেক বিয়েতে অসন্তোষ ও বিচ্ছেদ ঘটে, পারিবারিক সম্পর্ক বিঘ্নিত হয়, এবং নারীদের উপরে হিংসা বৃদ্ধি পায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর অসংখ্য নারী যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতার শিকার হন।

এই তথ্যগুলি প্রমাণ করে যে, যৌতুকের সামাজিক প্রভাব অত্যন্ত গভীর এবং এর বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন।

যৌতুক কি আইনগতভাবে বৈধ?

যৌতুক প্রথা মূলত ঐতিহ্যগত ও সামাজিক মূল্যবোধের একটি অংশ হিসেবে গণ্য হলেও, যৌতুক বিরোধী আইনকানুন অনুযায়ী এটি বেআইনি। বাংলাদেশে, ১৯৮০ সালে যৌতুক প্রথা আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যদিও বাস্তবে এর প্রচলন এখনো ব্যাপক।

আইন অনুযায়ী যৌতুক নেয়ার প্রবণতা

বাংলাদেশের ধারা বিবরণীতে দেখা যায়, ১৯৪৫-১৯৬০ সালের মধ্যে যৌতুকের হার মাত্র ৩% ছিল, যা ২০০৩ সালে বেড়ে ৭৬% হয়েছিল। এই তথ্য বোঝায় যে, আইনি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, সমাজে যৌতুক গ্রহণ ও প্রদানের প্রবণতা এখনও বিদ্যমান।

যৌতুক বিরোধী আইন ও উদ্যোগ

  • বাংলাদেশে যৌতুক প্রতিরোধে আইন ১৯৮০ সালে চালু হয় যা যৌতুক দাবি করা এবং গ্রহণ করাকে অপরাধ বলে ঘোষণা করে।
  • এরপরও, সাংস্কৃতিক চাপ ও সামাজিক অভ্যাসের কারণে যৌতুকের প্রচলন কমেনি।
  • যৌতুকের আইনি অবস্থান জোরালো হলেও, আইনি প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

আইন প্রণয়ন ও সামাজিক উদ্যোগ সমন্বিতভাবে চালিয়ে গেলেই কেবল যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সঠিক মোকাবিলা সম্ভব।

যৌতুকের ওপর জনমত

বাংলাদেশে জনমত ও যৌতুক নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক স্তরে মতামতের পার্থক্য লক্ষণীয়। যদিও ধীরে ধীরে যৌতুকের সামাজিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে, এখনও অনেক বাধা এগিয়ে আসছে।

আরও পড়ুনঃ  কপিরাইট কি? বাংলাদেশের কপিরাইট ধারণা

যৌতুকের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি

সাধারণ মানুষের মধ্যে যৌতুক প্রথা এখনও কিছু ক্ষেত্রে মান্যতা পায়, যদিও এর বিরোধিতা ক্রমশ বাড়ছে। ধাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট ভবনে গত মাসে ৫৫ জন ব্যক্তি যৌতুকবিরোধী শপথ নিয়েছেন, যা জনমতের পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত।

যুব সমাজের মধ্যে যৌতুক নিয়ে আলোচনা

বিশেষ করে, যুব সমাজ ও যৌতুক বিরোধিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যুব সমাজ যৌতুক প্রথার বিরোধিতা করে বিবাহের নতুন রীতি গড়ে তুলছে, যা সামাজিক সমর্থন এবং বুঝতে সহায়ক।

  • নিয়াজি সাহেব (ভাইরাব) যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে যৌতুকবিরোধী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, তা এই ধারার প্রতীক।
  • অতি সম্প্রতি গ্রহণযোগ্য ১১০টি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪.১% সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধে কাজ করছে, যা আশাব্যঞ্জক।

ফলস্বরূপ, যৌতুক সংক্রান্ত জনমত ও সামাজিক পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যা সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে।

যৌতুকের বিকল্প কী?

যৌতুকের প্রথা পরিত্যাগ করে, সমাজে বিবাহ প্রথা পরিবর্তন সাধনের অনুষ্ঠানগুলো ক্রমশঃ জনপ্রিয় হচ্ছে। এর ফলে বিবাহিত জীবনে সমতা এবং মর্যাদার উন্নয়ন ঘটছে এবং দানের সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে।

বিশেষ প্রথা ও পরিবর্তনশীল বিবাহ

বিবাহ প্রথা পরিবর্তন এমন কিছু উদাহরণ নিয়ে আসে, যেখানে বিয়ে শুধু দুই মানুষের মধ্যেকার বন্ধন নয়, বরং তা সামাজিক সমতা এবং মর্যাদা সূচক হিসাবে কাজ করে। ইসলামের নানা প্রথা যেমন মহর বা ক্ষতিপূরণের ধারণা যৌতুকের বিকল্প হিসাবে কাজ করতে পারে।

বিয়ের অন্যথা: দানের ধারণা

দানের সংস্কৃতি শুধুমাত্র অর্থ প্রদানের প্রথা নয়, বরং এটি ভালোবাসা, সহযোগিতা, এবং ভুবনব্যাপী মৈত্রীর প্রকাশ। বিয়ের সময় সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে সমান দায়ভার নেয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

  1. পরিবারের গৃহীত পলিসি: বিয়ের উদযাপন যেন উভয় পরিবারের সক্ষমতানুযায়ী হয়, যাতে কোনো পক্ষকে অতিরিক্ত আর্থিক চাপের সম্মুখীন হতে না হয়।
  2. সামাজিক অবহেলা প্রতিরোধ: যৌতুক প্রথার অপকর্মগুলোর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন এবং সচেতনতামূলক ব্যবস্থা।
  3. দানের সংস্কৃতি বিস্তার: বিবাহের অংশ হিসেবে উভয় পক্ষের প্রণোদনা ও সমর্থনকে জোরদার করা।

এরূপে, বিবাহের নতুন রীতি ও যৌতুকের বিকল্প হিসেবে দানের সংস্কৃতি আমাদের সামাজিক কাঠামোয় এক স্বাগত যোগ। এটি না শুধুমাত্র অর্থনৈতিক চাপ কমায়, বরং তাঁবুর আওতায় সকলের মধ্যে সমতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করে, যা একটি সুস্থ ও সুখী সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুনঃ  বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ এবং প্রতিকার

যৌতুক ও নারীর অবস্থান

বাংলাদেশে যৌতুক প্রথার এক গভীর শিকড় রয়েছে যা নারীর জীবনে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব ফেলে। নারীর স্বাধীনতা এবং নারী শিক্ষা ও যৌতুক এর প্রতি প্রভাব এই প্রথার চরম প্রতিফলন।

যৌতুকের প্রভাবে নারীর স্বাধীনতা

নারীর স্বাধীনতা যখন আলোচনা করা হয়, তখন যৌতুক ও নারী এর সম্পর্ক অপরিহার্য ভাবে উঠে আসে। যৌতুকের দাবি নারীর সম্প্রীতি এবং স্বাধীনতা দুই-ই ক্ষুণ্ণ করে। আইনগত ও সামাজিক সুরক্ষার অভাবে, অনেক নারী পারিবারিক অবস্থানে অসমতার শিকার হয়।

নারীর শিক্ষার গুরুত্ব

নারীর শিক্ষা যৌতুক প্রথাকে প্রতিরোধের এক অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। যৌতুক ও নারীর অবস্থান নির্ণয়ে নারীর শিক্ষা ও যৌতুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষিত নারী সমাজে তার অধিকার এবং স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং তা তাকে যৌতুক সংক্রান্ত অন্যায্য চাহিদা এবং চাপ থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে।

  • সামাজিক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে শিক্ষা একটি মৌলিক উপাদান।
  • শিক্ষা নারীকে কর্মজগতে স্বাবলম্বী করে তোলে, যা তাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করে।

এগুলি হলো যে সকল ক্ষেত্র যেখানে নারী শিক্ষা ও যৌতুক এবং নারীর স্বাধীনতা সমাজের গভীরে প্রভাব ফেলে। এই কারণেই, যৌতুক প্রথার বিপরীতে লড়াইয়ের জন্য নারী শিক্ষাকে বৃদ্ধি দেওয়া আবশ্যক।

যৌতুকের সমাধান খুঁজে বের করা

চিরায়ত সামাজিক অভ্যাসের অংশ হিসেবে যৌতুক প্রথার অবসানের জন্যে সবথেকে বড় হাতিয়ার হল সামাজিক সচেতনতাশিক্ষা। ১৯৭৩ সাল থেকে “পারিবারিক সহিংসতা” শব্দটির প্রচলন শুরু হয়, যার মধ্যে যৌতুকের কারণে পরিবারের ভেতরে সংগঠিত হওয়া হত্যাকাণ্ড ও ঘটনাবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল। সামাজিক সচেতনতার প্রসার ঘটিয়ে এই প্রথার ক্ষতির বিষয়ে জনসচেতন করা অপরিহার্য।

সচেতনতা ও শিক্ষা

বিয়ের আগে ও পরে পাত্র-পাত্রী এবং পরিবারের মানসিক প্রস্তুতির বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া উচিত। যৌতুক নির্মূলে শিক্ষা ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস ও প্রথার বাইরে গিয়ে সমাজে নতুন ধরনের বিশ্লেষণ ও জ্ঞান সৃষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যৌতুক-বিরোধী প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন আসতে পারে।

সমাজসেবী সংস্থার ভূমিকা

বাংলাদেশে ও গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় যৌতুক নির্মূলের জন্য সমাজসেবী উদ্যোগগুলির অবদান অসামান্য। সরকার এবং এনজিওগুলি যৌতুক-বিরোধী আইন ও নীতি প্রণয়নে সহায়তা করেছে, তবে এর কার্যকর অনুশীলনে বিলম্ব এবং ঘাটতি বিদ্যমান। শিক্ষার মাধ্যমে গৃহিণী থেকে সমাজসেবায় নারীদের ভূমিকা বাড়িয়ে তুলে সমাজসেবী সংস্থাগুলি সমাজের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য এবং কল্যাণে মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হতে পারে।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button