অর্থনীতি কাকে বলে?
সংসারের আবাদি জমি থেকে জাতীয় সীমানা পেরিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থনীতির প্রভাব প্রসারিত। বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অর্থনীতির সংজ্ঞা শুধু মানব সম্পদের পরিচালনা বা আর্থিক লেনদেনে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর আওতায় আসে কৃষি, ব্যবসা, সাংস্কৃতিক অর্থনীতি, উন্নয়নমূলক অর্থনীতি, পরিবেশগত অর্থনীতির মতো বহুমুখী ক্ষেত্র। সুদূর প্রাচীন গ্রিস থেকে ‘Oikonomia’ শব্দটি এসে অর্থনৈতিক সিস্টেমের জটিল ব্যবস্থাকে ইঙ্গিত করে, যা বর্তমানে বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণের সহিত যুক্ত।
এই অর্থনীতি নানা ধরনের অর্থনৈতিক তত্ত্ব, যেমন মাইক্রো অর্থনীতি ও ম্যাক্রো অর্থনীতি, ম্যাথেম্যাটিকাল পদ্ধতি, অর্থমিতি, জাতীয় হিসাব, বিভিন্ন শাখা যেমন ব্যক্তিগত অর্থনীতি, ফার্ম অর্থনীতি, ও পরীক্ষামূলক অর্থনীতি এবং মনোবিকাশ ও উন্নয়নের অর্থনীতির জ্ঞানার্জন এবং ব্যবহারের প্রতি জোর দেয়। সামাজিক কল্যাণের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অর্থনীতির পরিচর্যাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, যা একটি দেশের মঙ্গল এবং সমৃদ্ধির প্রাথমিক চাবিকাঠি। অর্থনীতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে কতটা মিশে আছে, তা বুঝতে এই সংজ্ঞা ও গুরুত্ব গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।
অর্থনীতির সংজ্ঞা এবং গুরুত্ব
অর্থনীতির মৌলিক অর্থ হল সম্পদের প্রশাসন এবং তার বিভিন্ন এলাকা, যা মানুষ এবং সমাজের জীবনমান উন্নয়ন এবং কল্যাণ প্রক্রিয়াতে অপরিহার্য। অর্থনীতির অর্থ এবং অর্থনীতি গুরুত্ব এই দুই ধারনার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলে।
অর্থনীতির প্রাথমিক অর্থ
অর্থনীতি বলতে সাধারণত অর্থের বিজ্ঞানকে বোঝানো হয়, যা জাতির ধন-সম্পদের প্রকার এবং কারণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অধ্যয়ন করে। এডাম স্মিথের বক্তব্য অনুসারে, এটি সম্পদ উৎপাদন এবং বিতরণের বিজ্ঞান।
অর্থনীতির বিভিন্ন দিক
- সম্পদ বন্টন
- মার্শালের মতে, এটি ধন জমাকারীর চেয়ে মানব কল্যাণের দিকে গুরুত্ব দেয়।
- রবিনসের সংজ্ণা অনুসারে, সীমিত সম্পদ ও অসীম চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন।
অর্থনীতির সামাজিক প্রভাব
অর্থনীতির সামাজিক প্রভাব বিস্তৃত, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, এবং শিল্প সংগঠনের মতো বিভিন্ন সেক্টরে প্রয়োগ পায়। সামাজিক ইকোনমিক্স পদ্ধতি এই প্রভাবগুলির অধ্যয়ন করে, যাতে সমাজের উন্নয়নে আরও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
অর্থনীতির প্রধান উপাদান
অর্থনীতিকে বুঝতে গেলে তার কিছু মৌলিক উপাদান সম্পর্কে জানা প্রয়োজন, যা
অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূলভিত্তিরূপে কাজ করে থাকে।
সম্পদ
সম্পদ হলো সেই সব উপাদান যা থেকে আমরা পণ্য বা সেবা উৎপাদন করতে পারি। এগুলি হয়তো প্রাকৃতিক হতে পারে যেমন বনভূমি, খনিজ সম্পদ, বা মানুষের তৈরি যেমন মেশিনেরি এবং কারখানা। প্রতিটি সম্পদের একটি বিশেষ মূল্য রয়েছে যা তার চাহিদা ও সরবরাহ দ্বারা নির্ধারিত হয়।
চাহিদা এবং সরবরাহ
অর্থনীতিতে চাহিদা হলো কোনো পণ্য বা সেবার প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ এবং ক্রয় ক্ষমতা যা বাজারে এক নির্দিষ্ট মূল্যে প্রকাশ পায়। সরবরাহ হলো সেই পণ্য বা সেবার পরিমাণ যা ক্রেতাদের কাছে এক নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রীয়ের জন্য উপলব্ধ। বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যেকার সামঞ্জস্য দ্বারা পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয়।
মূল্যবোধ
অর্থনীতির আরেকটি মৌলিক উপাদান হলো মূল্যবোধ, যা ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলে। এই বোধ অর্থনৈতিক পদক্ষেপের পথ নির্দেশ করে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতি গঠনে সহায়তা করে। মূল্যবোধের মাধ্যমে, মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তাদের ব্যবহারিক প্রকাশ পায়।
অর্থনৈতিক সিস্টেমের প্রকারভেদ
অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ও প্রক্রিয়াগুলি বিশেষ করে অর্থনৈতিক সিস্টেমের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক। সম্পাদিত বাজার অর্থনীতি, পরিকল্পিত অর্থনীতি, এবং মিশ্র অর্থনীতি হলো তিনটি প্রধান প্রকারের অর্থনৈতিক সিস্টেম যা বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হয়।
বাজার অর্থনীতি
বাজার অর্থনীতি হলো একটি অর্থনৈতিক সিস্টেম যেখানে সরবরাহ ও চাহিদা বাজারের যোগানদাতা ও ক্রেতা দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই সিস্টেমে, মূল্য নির্ধারণ ও সম্পদ বণ্টন পুরোপুরি মুক্ত বাজারের উপর নির্ভর করে থাকে।
পরিকল্পিত অর্থনীতি
পরিকল্পিত অর্থনীতি প্রধানত একটি সিস্টেম যেখানে সরকারি নীতি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদন, বিতরণ ও মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে, সরকার বাজারের মুখ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে এবং জাতীয় অর্থনীতির সকল মৌলিক সিদ্ধান্ত নেয়।
মিশ্র অর্থনীতি
মিশ্র অর্থনীতি হলো বাজার অর্থনীতি ও পরিকল্পিত অর্থনীতির একটি সংমিশ্রণ। এই অর্থনৈতিক সিস্টেমে, কিছু সেক্টর সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বাকি সেক্টরগুলি মুক্ত বাজারের নিয়ম অনুসারে কাজ করে। এটি সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যক্তি উদ্যোগের মধ্যে একটি সুস্থ ভারসাম্য সৃষ্টি করে।
বিভিন্ন অর্থনৈতিক সিস্টেমের এই প্রকারভেদ বিশ্লেষণ ও বুঝার মাধ্যমে, আমরা সমাজ এবং অর্থনীতির কাঠামোকে আরো ভালোভাবে বোঝার ও উন্নত করার সুযোগ পাই। এই বিষয়গুলি গভীরভাবে জানা ও ব�
অর্থনীতির মূল তত্ত্ব
অর্থনীতির তত্ত্ব বিশাল এবং বহুমাত্রিক। এর মধ্যে ক্লাসিকাল অর্থনীতি, কিণসিয়ান ইকনোমিক্স এবং নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্ব সর্বাধিক প্রভাবশালী। প্রতিটি তত্ত্ব বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিচালনার বিধি ও চিন্তাধারা উপস্থাপন করে থাকে।
ক্লাসিকাল তত্ত্ব
ক্লাসিকাল অর্থনীতি মুক্ত বাজার এবং স্বয়ংক্রিয় সরবরাহ-চাহিদার ভারসাম্যের উপর জোর দেয়। এটি বাজার যে নিজে নিজে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি সমাধান করতে সক্ষম, এমন ধারণাকে প্রমোট করে।
কিণসিয়ান তত্ত্ব
অন্যদিকে, কিণসিয়ান ইকনোমিক্স সরকারি হস্তক্ষেপ এবং নীতিমালার মাধ্যমে বাজারের অস্থিরতাকে প্রশমিত করার উপায় হিসাবে গুরুত্ব দেয়। এটা মনে করে যে বেকারত্ব, মন্দা ইত্যাদি সমস্যা সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগত উদ্যোগের মাধ্যমে কমানো সম্ভব।
নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্ব
সাম্প্রতিকের নতুন অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলি, যেমন বিবর্তনীয় অর্থশাস্ত্র এবং অভিযানমূলক অর্থশাস্ত্র, আরও ব্যাপক গবেষণা ও প্রযুক্তিগত প্রগতির দিকে নিয়োজিত। এগুলি অর্থশাস্ত্রের পারম্পরিক মোডেলগুলোকে প্রশ্ন করে এবং নতুন ধারণা প্রদান করে থাকে।
এই তত্ত্বগুলি অর্থনীতির তত্ত্বের ব্যাপ্তি ও গভীরতা বাড়িয়ে তোলে, এবং অর্থনীতিবিদদের নতুন করে চিন্তা করার সুযোগ প্রদান করে। ফলস্বরূপ, অর্থনীতিতে অগ্রগতি ও উন্নতি অব্যাহত থাকে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন
এক জাতির প্রগতির মাপকাঠি অনেকাংশে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে প্রতিফলিত হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, উন্নতির যাত্রায় শুধু অর্থনীতির আকার বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, বরং এর সাথে সর্বাঙ্গীন উন্নয়নের ধারা বৃদ্ধি পেতে হবে যাতে দেশের সব মানুষের উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত হয়।
প্রবৃদ্ধির ধারণা
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলো একটি দেশের জাতীয় আয় এবং উৎপাদনের ক্ষমতার বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশগত বিবেচনা সহ অর্থনীতির মূল সূচকগুলি উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশের গত ৫২ বছরের স্বাধীনতা যাত্রায় আর্থিক উন্নয়নের হার প্রশংসনীয় থাকলেও, সামাজিক ও সার্বিক উন্নয়নের সাথে এর সমন্বয় সাধনে বাকি রয়েছে।
উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক
উন্নয়ন পুরাপুরি মানবিক প্রয়োজনের প্রতিফলন, যেখানে “হুমান সেন্টার্ড ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স” দ্বারা পেশা অনুযায়ী উন্নয়নের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এই সূচকের অধীনে, মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার, এবং স্বাস্থ্য সুবিধা যেমন কারিগরি দিকগুলির উন্নতি বিবেচনা করা হয়। তবে, দায়বদ্ধ সরকারি ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক সুশাসনের অভাবে, অর্থনীতির উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।