বাজেট কি?
বাজেটের অর্থ হলো আর্থিক পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি দেশ বা সংস্থা, এমনকি একজন ব্যক্তির সম্ভাব্য আয় ও ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট একটি অনুমানিক এবং যুক্তিসংগত চিত্র। এর মূল উদ্দেশ্য হলো আয় এবং ব্যয়ভার নির্ধারণ করা এবং সেগুলোকে সঠিকভাবে মাপা এবং নিয়ন্ত্রণ করা। বাংলাদেশে, বাজেট প্রস্তাবনা আমাদের অর্থবছরের জন্য ১২ মাস সময়কালের জন্য প্রভাবিত হয়, যা চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে পরের বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সার্বিক আর্থিক পরিকল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বর্তমানে সক্রিয় বাজেট, যা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট হিসাবে পরিচিত, বিডিটি ৭,৬১,৭৮৫ কোটি পরিমাণে আর্থিক মন্ত্রী A.H.M Mustafa Kamal কর্তৃক ১ জুন ২০২৩ তারিখে ঘোষিত হয়। এই পরিমাণটি আমাদের অর্থনীতির বৃহত্তর পরিমাণ ব্যয়ভারের গরিমা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়, এবং সাধারণত এই ব্যয়ের মধ্যে প্রতিরক্ষা, আইন শৃঙ্খলা, এবং প্রশাসনিক খরচগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকে। বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন দুইটি প্রধান উপায়ে পরিচালিত হয়ে থাকে: সরকারী রাজস্ব উত্স এবং উন্নয়ন বাজেটের মাধ্যমে।
বাজেটের অর্থ কী?
প্রতি বছর, বাংলাদেশ সরকার একটি বাজেট প্রণয়ন করে, যা জুলাই মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত চলে। এই বাজেটের মাধ্যমে, সরকার তার আয় ও ব্যয়ের একটি যথার্থ হিসাব উপস্থাপন করে, যা অর্থবছরের হিসাব হিসেবে পরিচিত।
বাজেটের সংজ্ঞা
সহজ ভাষায়, বাজেটের সংজ্ঞা হচ্ছে একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য একটি সংস্থা অথবা ব্যক্তির আনুমানিক আয় ও ব্যয়ের পূর্বানুমান। এটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এর মাধ্যমে আর্থিক লক্ষ্যগুলি ঠিক রাখা সম্ভব হয়।
বাজেটের প্রকারভেদ
বাংলাদেশে প্রধানত দুই ধরনের বাজেট দেখা যায়: উদ্বৃত্ত বাজেট এবং ঘাটতি বাজেট। উদ্বৃত্ত বাজেটে, মোট আয় ব্যয়ের চেয়ে বেশি থাকে, অন্যদিকে ঘাটতি বাজেটে মোট ব্যয় আয়ের চেয়ে বেশি হয়। প্রতিটি বাজেটের প্রকার তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, যা সংস্থা অথবা সরকারকে আর্থিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সহায়তা করে।
- সুসম বাজেট: আয় এবং ব্যয় সমান থাকে।
- অসম বাজেট: আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকে, যা সাধারণত ঋণের মাধ্যমে পূরণ করা হয়।
প্রতিটি বাজেটের প্রকার নির্দিষ্ট আর্থিক অবস্থা ও পরিকল্পনার ভিত্তি তৈরি করে যা আর্থিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে অবদান রাখে।
ব্যক্তিগত বাজেট
ব্যক্তিগত বাজেট প্রত্যেকের জীবনে একটি অপরিহার্য অংশ। এটি আর্থিক পরিকল্পনা ও ব্যয় নির্ধারণের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ও সামর্থ্য নিশ্চিত করে। প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক লাভের পাশাপাশি, এটি ভবিষ্যতের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য একটি আর্থিক বাফার তৈরি করে।
অর্থ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব
ব্যক্তিগত বাজেট আপনাকে সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করতে সাহায্য করে, যা আয় ব্যয়ের একটি সুসংহত সমন্বয় তৈরি করে। এর ফলে, ব্যক্তি অনাহূত খরচ এড়াতে এবং সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়।
বাজেট তৈরির পদক্ষেপ
- আয়ের উৎস চিহ্নিত করুন: আপনার সমস্ত আয়ের উৎস নির্ধারণ করা প্রথম ধাপ।
- ব্যয় নির্ধারণ: দৈনন্দিন খরচ বাজেটে তালিকাভুক্ত করুন।
- সাশ্রয়ী লক্ষ্য স্থির করুন: প্রতি মাসে কি পরিমাণ সঞ্চয় করতে চান তা নির্ধারণ করুন।
সুসংহত ব্যক্তিগত বাজেট আপনাকে আর্থিক সুরক্ষা এবং শান্তি প্রদান করে। তাই, এটি তৈরি করা এবং যথাযথভাবে ব্যবহার করা উচিত।
কর্পোরেট বাজেট
কর্পোরেট বাজেট প্রণয়ন হচ্ছে একটি কোম্পানির আর্থিক কাঠামো ও সার্বিক পরিচালনার অঙ্গ। এই বাজেটের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান তার আগামী ব্যবসা পরিকল্পনা ও আর্থিক প্রক্রিয়াগুলিকে সুসংগঠিত করে।
কর্পোরেট বাজেটের উপাদান
কর্পোরেট বাজেটের প্রধান উপাদানসমূহ হলো প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, এবং সঞ্চিত ডাটা। এই উপাদানগুলি কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে এবং ব্যবসা পরিকল্পনার ভিত্তি স্থাপন করে।
- প্রতিবেদন: কোম্পানির বিভিন্ন খাতের আয় এবং ব্যয় প্রতিবেদন।
- বিশ্লেষণ: বিগত বছরের বাজেট ও বাস্তবায়িত হিসাবের সম্পর্কিত বিশ্লেষণ।
- ডাটা: বিগত কয়েক বছরের ডাটার তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রদান করা।
পরিকল্পনা ও পরিচালনার সম্পর্ক
ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও কর্পোরেট বাজেটের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বাজেট প্রনয়নের মাধ্যমে কোম্পানি তার আর্থিক লক্ষ্যাবলীকে সুনির্দিষ্ট করে এবং পরিচালনা টিমকে সেই মাত্রায় নিয়ে যায় যাতে কোম্পানির সার্বিক উন্নতি সম্ভব হয়।
- লক্ষ্য নির্ধারণ: একটি সুস্থ ও সহনীয় রাজস্ব লক্ষ্য নির্ধারণ।
- সমন্বয়: বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন।
- মূল্যায়ন: কোম্পানির প্রতিটি বাজেটের নিয়মিত মূল্যায়ন।
অন্যান্য কর্পোরেট বাজেটের মতো, ব্যবসা পরিকল্পনা এবং আর্থিক প্রক্রিয়া গুলি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় যা কোন প্রতিষ্ঠানের স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করে।
সরকারের বাজেট
সরকারি বাজেট একটি জটিল আর্থিক পরিকল্পনা যা জাতীয় পর্যায়ের আয় এবং ব্যয়ের একটি সুসংহত নথি। বাংলাদেশে এই অর্থবছর প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া একাধিক ধাপে ভাগ করা হয়, যা এক বছরের জন্য পরিকল্পিত হয়।
সরকারের বাজেট পরিকল্পনা
বাংলাদেশের সরকারি বাজেট পরিকল্পনা অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়। এই পরিকল্পনা অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সূত্রগুলির একটি অনালোচিত সমন্বয় এবং তা দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের আর্থিক পরিকল্পনার গতিপথ নির্ধারণ করে।
বাজেটের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের অর্থবছরের জন্য পরিকল্পিত বাজেট জাতীয় পার্লামেন্টে জুন মাসে উপস্থাপিত হয়। এ প্রক্রিয়ায়, বাজেট বিল আইনী, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক বিবেচনার ভিত্তিতে গৃহীত হয়। বাজেট বাস্তবায়নের সময়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তর নিজ নিজ বাজেটের মাধ্যমে এর কার্যকরতা নিশ্চিত করে থাকে।
- ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য মোট ব্যয় ৭,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা পরিকল্পিত।
- বাজেট প্রস্তুতিতে অর্থনীতিক পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন করা হয়।
বাজেটের সুবিধা
একটি ভালো পরিকল্পিত বাজেট অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ এবং সঞ্চয়-বিনিয়োগের কৌশল তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। এটি বিনিয়োগের অগ্রাধিকার নির্ধারণে সাহায্য করে এবং সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে একটি সুস্বাস্থ্যকর গাইড লাইনের ভূমিকা পালন করে।
খরচ নিয়ন্ত্রণ
সঠিক বাজেটিং প্রক্রিয়া অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান তার সকল খরচের উপর একটি কঠোর নজর রাখতে পারে, যা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করে।
সঞ্চয় ও বিনিয়োগ
একটি কার্যকর বাজেট সঞ্চয়ের কৌশল উন্নত করতে এবং বিনিয়োগের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে সহায়তা করে। এর ফলে অর্থ সঞ্চয় এবং সঠিক সেক্টরে বিনিয়োগ করা সহজ হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে দেয়।
- অর্থ সংগ্রহ এবং ব্যয় পরিকল্পনা করা।
- অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো।
- সঞ্চয় সৃষ্টি এবং নিরাপদ বিনিয়োগের সুযোগ চিহ্নিত করা।
একটি সঠিক বাজেট পরিকল্পনা যে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সফলতা নিশ্চিত করে, সেই সাথে এটি ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে উন্নত করতে সহায়তা করে।
বাজেট তৈরির উপায়
সুষ্ঠু আর্থিক পরিকল্পনা ও সঠিক বাজেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে বাজেট তৈরির প্রথম ধাপ হলো সম্পূর্ণ মাসিক আয় ও ব্যয়ের যথাযথ তালিকা প্রণয়ন। এই তালিকা প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রতিটি খরচের হিসেব রাখা গুরুত্বপূর্ণ—খাদ্য, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যক্তিগত খরচ, সঞ্চয়, এবং বিবিধ খরচ সহ।
মধ্যবিত্ত পরিবারে, মাসিক খরচের ৪০% থেকে ৬০% পর্যন্ত খাদ্যে ব্যয়বহুল হতে পারে, অন্যদিকে নিম্ন আয়ের পরিবারে এটি বেড়ে ৮০% পর্যন্ত হতে পারে। এসব তথ্য বাজেট তৈরিতে অত্যন্ত সহায়ক।
আয় এবং ব্যয়ের তালিকা
প্রতিটি মাসের শুরুতে আয় ও ব্যয়ের একটি সুষ্ঠু তালিকা তৈরি করা ভালো। এটি বাজেটিং সহায়তা দেয় এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
বাজেটিং সফটওয়্যার ও টুলস
- বিভিন্ন বাজেটিং সফটওয়্যার যেমন Quicken, YNAB, অথবা Mint ব্যবহার করা যেতে পারে বাজেট তৈরি ও অনুসরণে।
- এসব টুলস ব্যয় ট্র্যাকিং, সঞ্চয় লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা, এবং আর্থিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।
এই পদ্ধতি ও সরঞ্জামগুলো ব্যক্তিগত এবং পেশাগত বাজেটিংয়ে উন্নতি সাধনে এবং আর্থিক পরিকল্পনায়ের দক্ষতা বাড়াতে কাজ করে।
বাজেটের চ্যালেঞ্জ
বাজেট প্রণয়নের সময় বিভিন্ন ধরনের বাজেটিং চ্যালেঞ্জ ও আর্থিক পরিবর্তন প্রতিফলিত হয় যা প্রায়শই বাজেট পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করে। এসব চ্যালেঞ্জ গুলির মধ্যে অন্যতম হলো পরিকল্পনার ত্রুটি যা পূর্ণাঙ্গ এবং কার্যকর পরিকল্পনা না থাকায় উদ্ভূত হয়।
বাজেট তৈরির সাধারণ ভুল
বাজেট তৈরির সময় অপর্যাপ্ত আন্তরিকতা এবং পূর্বাভাসের ভুল ব্যাখ্যা বাজেটিং চ্যালেঞ্জ-এর বড় যুক্তি। মূল্যস্ফীতির মতো আর্থিক পরিবর্তন বারবার বাজেটের প্রাক্কলনকে ব্যাহত করে থাকে।
পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির প্রভাব
- রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পর্যালোচনা অভাবের ফলে পরিকল্পনার ত্রুটি প্রকট হয়।
- ক্রুদ্ধ এবং গতিশীল বাজার পরিস্থিতির সন্ধানে বাজেটকরণের পদ্ধতিগুলি কতটা মানানসই তা নির্ধারণ করা।
এসব প্রেক্ষিতে, বাজেট প্রণয়নকারীদের উচিত আগাম পর্যালোচনা এবং পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিগুলির প্রতি সচেতন থাকা।
সংস্থার বাজেট
সংস্থার আর্থিক পরিকল্পনা একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের অন্যতম ভিত্তি। এটি নিশ্চিত করে যে প্রতিটি বিভাগের আয়-ব্যয় এবং তার অবদান সংস্থার মোট লক্ষ্যপূরণে সাহায্য করছে।
বাজেটের পরিকল্পনা দল
সংস্থার বাজেট তৈরির প্রক্রিয়াটি একটি দলগত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই দল অন্তর্ভুক্ত বিশেষজ্ঞদের মেধা এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়, বিভাগীয় তথ্যগুলি সংগ্রহ করে এবং আর্থিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে।
বিভাগের বাজেট দায়িত্ব
প্রতিটি বিভাগ নিজেদের বাজেটের জন্য দায়ী। বিভাগীয় বাজেট সাধারণত আগাম নির্ধারণ করা হয় এবং বছর ধরে তারা যেন তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিদিষ্ট পরিসীমা মান্য করে চলে সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি থাকে। সর্বোপরি, প্রত্যেক বিভাগের বাজেট সামগ্রিক সংস্থার লক্ষ্যের সাথে সাংগঠনিক সম্মতিতে থাকা উচিত।