গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল?

বাংলাদেশের মায়েদের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের প্রসার বেশ উদ্বেগজনক; প্রতি ৮ থেকে ১৩ শতাংশ নারী তাদের গর্ভাবস্থায় এই অবস্থার সাথে যুদ্ধ করছেন। গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক ব্লাড সুগার এবং গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের মাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু এই জটিলতা না শুধু মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য, বরং শিশুর বিকাশ এবং জন্মের পরের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও প্রভাব ফেলে।

জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের সাথে জড়িত ঝুঁকিতে থাকা মায়েদের প্রাথমিক ফলোআপে অবশ্যই ডায়াবেটিসের স্ক্রীনিং টেস্ট করা উচিত। অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে মুখ শুকিয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি, এবং অস্বাভাবিক পিপাসা রয়েছে, যা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সংকেত দেয়। সন্তানের জন্মের পর সুস্থতার জন্য গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক ব্লাড সুগারের মাত্রা সহ একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করা জরুরি।

Contents show

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কি?

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হল এমন এক অবস্থা, যেখানে গর্ভবতী মায়ের শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিকরূপে বৃদ্ধি পায়, যা গর্ভকালীন সময়ের শ্রেণীবিন্যাসে পড়ে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ধরন

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের মূলত দুই ধরন রয়েছে: গর্ভধারণের আগে থেকেই যেসব মহিলা ডায়াবেটিক ছিলেন (টাইপ ১ অথবা টাইপ ২) এবং যাদের গর্ভধারণের সময় নতুন করে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস উদ্ভূত হয়- যাকে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলা হয়।

রিস্ক ফ্যাক্টর

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকির কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে বয়স, ওজন, এবং পারিবারিক ডায়াবেটিসের ইতিহাস। অতিরিক্ত ওজনসম্পন্ন হলে বা পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের

গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক ব্লাড সুগার মাত্রা

গর্ভাবস্থায় ব্লাড সুগারের মান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত গর্ভাবস্থায় রক্তে সুগারের পরিমাণ সঠিক মাত্রায় রাখা মায়ের ও ভবিষ্যৎ সন্তানের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ত্রৈমাসিক অনুযায়ী সুগার লেভেল

গর্ভাবস্থায় গ্লুকোজের মাত্রা প্রথম তিন মাস এবং পরবর্তী সময়ে ভিন্ন থাকতে পারে। গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে সাধারণত নিম্ন রক্তে সুগারের মাত্রা (৯০ মিলিগ্রাম/ডিএল বা তার চেয়ে কম) দেখা দেয়। পরবর্তী ত্রৈমাসিকগুলিতে, বিশেষ করে ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে, গর্ভাবস্থায় গ্লুকোজের মাত্রা সস্তনভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  দ্রুত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার উপায়

স্বাভাবিক মানদণ্ড

  • খাওয়ার আগে: ৯০ মিলিগ্রাম/ডিএল বা কম
  • খাওয়ার এক ঘন্টা পর: ১৩০-১৪০ মিলিগ্রাম/ডিএল বা কম
  • খাওয়ার দুই ঘন্টা পর: ১২০ মিলিগ্রাম/ডিএল বা কম

এই মানগুলি অতিক্রম করলে, গর্ভাবস্থায় ব্লাড সুগারের মান উচ্চ হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা গেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের ইঙ্গিত দিতে পারে। এই অবস্থাটি গর্ভকালীন নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

সঠিক পুষ্টি, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, এবং নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রক্তে সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এছাড়াও, গর্ভাবস্থায় ব্লাড সুগারের মান সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নির্ধারিত পরীক্ষাগুলি নিয়মিত সম্পাদন করা উচিত।

ডায়াবেটিসের প্রভাব গর্ভাবস্থায়

গর্ভাবস্থা হলো এমন একটি সময় যখন মা এবং সন্তানের স্বাস্থ্য অত্যন্ত প্রাধান্য পায়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের প্রভাব এবং ডায়াবেটিস এবং গর্ভাবস্থার জটিলতা অনেক সময়েই গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।

গর্ভকালীন স্বাস্থ্য ঝুঁকি পূর্ণ মাতৃত্বের জন্য সঠিক পরিচর্যা ও মনিটরিং এর গুরুত্ব বৃদ্ধি করে। এই সময়ে ঠিক ডায়াগনোসিস এবং চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনুসরণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে।

গর্ভের সন্তানের স্বাস্থ্য

গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস থেকে জন্ম নিতে পারে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা। যেমন:

  • ম্যাক্রোসমিয়া (শিশুর বড় আকার)
  • জন্মগত ত্রুটির যেমন এনিসেফালি, মাইক্রোসিফালি
  • নিউরাল টিউব ডিফেক্ট

মায়ের স্বাস্থ্যে প্রভাব

মাতার ডায়াবেটিস থেকে বিভিন্ন জটিলতা জন্ম নিতে পারে:

  • গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ
  • অতিরিক্ত অ্যামনিওটিক তরল
  • প্রসবকালীন সময়ে সংক্রমণের ঝুঁকি

এই সমস্ত ঝুঁকি ও জটিলতার পূর্বে সচেতন হওয়া এবং যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।

ডায়াবেটিস পরীক্ষার পদ্ধতি

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য নির্দিষ্ট এবং কার্যকরী পরীক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজন হয়, যাতে মাতৃ এবং শিশুর স্বাস্থ্য নিরাপদ থাকে। এই পরীক্ষাগুলো অন্যন্যা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং ব্লাড সুগার মাপার পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

ব্লাড সুগার টেস্টের প্রকারভেদ

গর্ভাবস্থায় ব্লাড সুগার পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরণের টেস্ট প্রচলিত রয়েছে, যেমন:

  • ফাস্টিং ব্লাড সুগার টেস্ট (FBST)
  • অরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT), যা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয় করতে গুরুত্বপূর্ণ
  • হেমোগ্লোবিন A1c টেস্ট, যা গত তিন মাসের গড় ব্লাড সুগার মাত্রা দেখায়
আরও পড়ুনঃ  হারপিস সোর দ্রুত নিরাময় করার উপায়

এসব ডায়াবেটিস ডায়াগনস্টিক টেস্ট গর্ভকালীন সময়ের বিভিন্ন দফায় পরিচালিত হয়।

পরীক্ষার সময়সূচি

গর্ভাবস্থায় ব্লাড সুগার পরীক্ষার সময়সূচি নির্দিষ্ট এবং সুনির্ধারিত। সাধারণত, গর্ভধারণের 24 থেকে 28 সপ্তাহের মধ্যে অরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT) সম্পন্ন করা হয়। এই পরীক্ষা:

  1. গ্লুকোজের প্রাথমিক মাত্রা নির্ণয় করে।
  2. 75 গ্রাম গ্লুকোজ গ্রহণের পরে প্রতি ঘণ্টা ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা হয়, যা তিন ঘণ্টা পর্যন্ত চলে।
  3. এর ফলাফল গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের অস্তিত্ব নির্ধারণ করে।

সব মহিলাদের জন্য এই পরীক্ষা আবশ্যক এবং চিকিৎসকের নির্দেশ মতো অনুসরণ করা উচিত।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাস

গর্ভকালীন সময়ে মায়ের ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক খাদ্যাভ্যাস গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস এবং ডায়েটের মান বজায় রাখতে এবং নানান শারীরিক জটিলতা থেকে মা ও সন্তানকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।

স্বাস্থ্যকর খাদ্য নির্বাচন

ডায়াবেটিস এবং সুস্থ খাদ্যভ্যাস গর্ভকালীন সময়ের জন্য একটি মৌলিক উপাদান। গর্ভকালীন মায়েদের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাসে বিভিন্ন ফল, শাক-সবজি, প্রোটিন এবং দৈনিক প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেট অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এই খাবারগুলি রক্তের সুগার স্তরকে স্থিতিশীল করে এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

খাবারের সময়সূচি

সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে খাওয়া গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ সাধনে ভূমিকা রাখে। প্রতিদিনের খাদ্য সূচি যথাযথ ভাবে পরিকল্পিত হলে, ব্লাড সুগার মান সহনীয় সীমায় বজায় থাকে এবং ইনসুলিনের প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। বুঝতে হবে যে, খাবারের সময়সূচি এবং খাদ্যের মানের সঠিক ব্যবস্থাপনা গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের লক্ষ্যে হাতিয়ার।

শারীরিক কার্যকলাপের ভূমিকা

গর্ভাবস্থায় সঠিক শারীরিক কার্যকলাপের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষজ্ঞরা গর্ভকালীন ব্যায়াম এবং নিরাপদ শারীরিক কার্যকলাপকে উৎসাহিত করে থাকেন, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যায়াম হিসেবে কাজ করে থাকে। একটি নিরাপদ ও সুষম ব্যায়াম পরিকল্পনা মা এবং ভ্রূণের স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে পারে।

নিরাপদ ব্যায়ামের ধরণ

  • হালকা হাঁটা
  • সুইমিং
  • জেন্টল ইয়োগা

এই ধরণের ব্যায়ামগুলি অস্তিত্ব চাপ ও মেজাজ উন্নত করতে সমান ভাবে সহায়তা করে, যা গর্ভকালীন কালে খুবই জরুরি।

গুরুত্ব এবং উপকারিতা

  1. ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ করে।
  2. ঘুমের মান উন্নত করে।
  3. প্রসবের সময় শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
আরও পড়ুনঃ  চিয়া সিড খেলে কি ওজন বাড়ে?

এই উপকারিতা গুলি মা এবং শিশু উভয়ের জন্য প্রসবের পর স্বাস্থ্য ও সুখী জীবন নিশ্চিত করে থাকে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিরাপদ শারীরিক কার্যকলাপ অত্যন্ত জরুরি।

চিকিৎসা নীতি ও নির্দেশনা

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস চিকিৎসা বিষয়ক যত্ন এবং নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট মেডিকেল কেয়ার এবং ধারণা অনুসারে চিকিৎসা পদ্ধতি পরিকল্পিত হয় যা গর্ভবতী মায়ের এবং অনাগত শিশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখে।

ওষুধের ব্যবহার

  • গর্ভাবস্থায় ওষুধ পদ্ধতি অনুসরণ করা মায়ের এবং শিশুর জন্য নিরাপদ ও কার্যকরী।
  • ইনসুলিন প্রয়োগের মাধ্যমে ব্লাড গ্লুকোজ লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
  • অন্যান্য নির্দিষ্ট ওষুধের ব্যবহার ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে চলা, যা গর্ভস্থ শিশুর ঝুঁকি কমায়।

ডাক্তারি পরামর্শ

  • নিয়মিত মেডিকেল চেক-আপ এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা দ্বারা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সম্ভব।
  • আহার এবং ব্যায়ামের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  • গর্ভাবস্থা জুড়ে জটিলতা এড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট মেডিকেল কেয়ারের গুরুত্ব।

গর্ভাবস্থায় আপাদমস্তক যত্ন নিয়ে, সঠিক মেডিকেল কেয়ার এবং ওষুধ পদ্ধতির মাধ্যমে মা এবং শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের লক্ষণ

গর্ভাবস্থায় মাতৃদেহের ভেতর অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়, যার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের বিভিন্ন লক্ষণ প্রকট হতে পারে যা অবহেলা করা উচিৎ নয়। প্রায়শই, বারবার প্রস্রাব যাওয়া, মুখ শুষ্ক অনুভব করা, প্রচুর তৃষ্ণা, ক্লান্তি, দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া এবং মূত্রনালীর সংক্রমণ এই উপসর্গগুলো অন্তর্ভুক্ত।

প্রথমিক লক্ষণ সমূহ

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের প্রথমিক লক্ষণগুলো সাধারণত খুব স্পষ্ট নাও হতে পারে। আশির সপ্তাহ (২৮ সপ্তাহ) বা তার অধিক গর্ভাবস্থায় এর সনাক্তকরণ সম্ভব। একজন গর্ভবতী মহিলা, যদি আগে থেকেই ডায়াবেটিসের সাথে জড়িত থাকেন, তবে তার ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির জন্য বিশেষ পরীক্ষা প্রয়োজন হয়, যেহেতু গর্ভাবস্থায় চোখের সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে।

সতর্ক

গর্ভাবস্থায় শারীরিক গতিবিধির মতো নিয়মিত গ্লুকোজ পরীক্ষা, হাঁটাহাঁটি, কার্বোহাইড্রেটের পরিমিত গ্রহণ, মিষ্টিজাতীয় খাদ্য পরিহার এবং চাপ এড়িয়ে চলা উচিত। আবশ্যিকভাবে, ডাক্তার কখনও কখনও মৌখিক ওষুধ বা ইনসুলিনের প্রেসক্রিপশন করতে পারেন। বিধি-নিষেধ ও উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে, গর্ভাবস্থায় সুস্থ ডেলিভারি সাধন সম্ভব।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button