রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কি সমস্যা হয়?

রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি বর্তমানে একটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গণ্য হচ্ছে, যা বিভিন্ন রকমের রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার সৃষ্টি করে। এ অবস্থা ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক দুর্বলতা ডেকে আনতে পারে; বিশেষ করে ভারতের মতো দেশগুলিতে, যেখানে নারীদের মধ্যে আয়রনের অভাব জনিত রক্তাল্পতার সমস্যা বেড়ে চলেছে। এর ফলে না শুধু সাধারণ ক্লান্তি এবং মাথাব্যথা দেখা দেয়, বরং শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ হ্রাস পেয়ে ত্বক এবং চুলের সমস্যাসহ বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্যগত অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে।

সচেতনতা এবং সঠিক পুষ্টির মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন ঘাটতি মোকাবেলার পথ খোঁজা সম্ভব। আয়রন-সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন পোল্ট্রি, মাছ, ডিম, এবং ভিটামিন সি যুক্ত ফলমূল গ্রহণ করার মাধ্যমে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে পারি। বস্তুত, সময়মত রক্তের পরীক্ষা এবং যথাযথ মেডিক্যাল সুপারিশ মেনে চলা আমাদের স্বাস্থ্যের অন্যতম সম্পদ হতে পারে।

হিমোগ্লোবিন কি এবং এর ভূমিকা

হিমোগ্লোবিনের গবেষণা ও বোঝাপড়া আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অপরিহার্য। এটি এমন একটি প্রোটিন যা লোহিত রক্তকণিকাগুলিতে পাওয়া যায় এবং মৌলিকভাবে অক্সিজেন পরিবহন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করে।

হিমোগ্লোবিনের সংজ্ঞা

হিমোগ্লোবিন, যাকে সংক্ষেপে এইচবি বলা হয়, হল একটি জটিল হিমোগ্লোবিন প্রোটিন যা প্রধানত আয়রন যুক্ত হেম গ্রুপ এবং গ্লোবিন প্রোটিন দ্বারা গঠিত। এর চারটি প্রোটিন উপাদান রয়েছে যা অক্সিজেন আবদ্ধ করতে এবং পরিবহন করতে সক্ষম।

রক্তে হিমোগ্লোবিনের কাজ

হিমোগ্লোবিনের মূল কাজ হল ফুসফুস থেকে গৃহীত অক্সিজেনকে শরীরের বিভিন্ন টিস্যু ও কোশে পৌঁছে দেওয়া। এটি লোহিত রক্তকণিকাগুলির মাধ্যমে চলাচল করে এবং শ্বাস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোশ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড ফুসফুসে ফিরিয়ে আনে যাতে তা বাতাসে মিশে যায়।

  • অক্সিজেন পরিবহনে হিমোগ্লোবিন একটি ক্রুশিয়াল ভূমিকা রাখে, যা শরীরের সকল ভাইটাল ফাংশনের জন্য প্রয়োজনীয়।
  • এছাড়াও, হিমোগ্লোবিন হিমোগ্লোবিন প্রোটিন হিসেবে শরীরের pH ব্যালান্স রক্ষায় সহায়তা করে এবং বৃহত্তর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখে।
আরও পড়ুনঃ  শরীরে রক্ত কম হলে কি কি সমস্যা হয়?

হিমোগ্লোবিনের কমে যাওয়ার কারণ

হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যাওয়ার নানা কারণের মধ্যে পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতা, এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রধান। সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং আমাদের পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবারের অভাব এসব সমস্যার মূলে।

পুষ্টিহীনতা

বিশেষত, ভারতীয় জনগণের মধ্যে পুষ্টিহীনতা একটি প্রধান সমস্যা যা আমাদের শরীরে সঠিক অনুপাতে ভিটামিন, খনিজ, এবং পুষ্টি দ্রব্যের প্রয়োজন, এর বিপরীতে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস অপর্যাপ্ত।

রক্তশূন্যতা

  • অ্যানিমিয়া, অর্থাৎ রক্তশূন্যতা হলো রোগের অবস্থা যেখানে রক্তে লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে।
  • আয়রনের অভাব জনিত রক্তাল্পতা ঘটে শরীরে পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা না থাকলে, যা রক্তের অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা হ্রাস ঘটায়।

দীর্ঘস্থায়ী রোগ

বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ট্রমা বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রক্তপাত রক্তাল্পতার একটি প্রধান কারণ হতে পারে। এসব রোগে রক্তের লোহিত কণিকার উৎপাদন হ্রাস পায় অথবা লোহিত রক্তকণিকা ভাঙ্গন বৃদ্ধি পায়।

বিভিন্ন ধরনের রক্তশূন্যতা

রক্তশূন্যতা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যার প্রতিটির নিজস্ব কারণ এবং প্রভাব রয়েছে। এই অধ্যায়ে, আমরা দুটি প্রধান প্রকারের রক্তশূন্যতা, আইরন ডিফিশিয়েন্সি অ্যানিমিয়া এবং ভিটামিন বি12 ডিফিশিয়েন্সি অ্যানিমিয়া সম্পর্কে আলোচনা করব।

আইরন ডিফিশিয়েন্সি অ্যানিমিয়া

আইরন ডিফিশিয়েন্সি অ্যানিমিয়া হল সবচেয়ে সাধারণ প্রকারের রক্তাল্পতা। এটি সাধারণত খাদ্যে লোহার অপর্যাপ্ত গ্রহণের ফলে ঘটে এবং সাধারণত মহিলাদের মধ্যে অধিক প্রচলিত। এই অবস্থা গর্ভাবস্থায় জটিলতা সৃষ্টি করে কারণ সে সময় রক্তের প্রয়োজন বেশি হয়।

ভিটামিন বি12 ডিফিশিয়েন্সি অ্যানিমিয়া

ভিটামিন বি12 অভাব এমন একটি অবস্থা যা শরীরে লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। ভিটামিন বি12 এর অভাব জীবনীয় এবং আণবিক পর্যায়ে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এই অবস্থা সাধারণত অপর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ করলে ঘটে থাকে, বিশেষ করে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস অনুসরণকারীদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়।

এই দুই ধরনের রক্তশূন্যতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে এই অবস্থাগুলির প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা যেতে পারে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করা যেতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  থ্যালাসেমিয়া কি ভালো হয়?

লক্ষণ এবং উপসর্গ

রক্তাল্পতার লক্ষণ সাধারণত ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে, যা ব্যক্তির সাধারণ জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে ক্লান্তি এবং দুর্বলতা অন্যতম প্রধান লক্ষণ।

ক্লান্তি এবং দুর্বলতা

রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক পরিমাণের কমে যাওয়া ক্লান্তি এবং দুর্বলতার প্রধান কারণ। এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে, ব্যক্তির দৈনন্দিন কার্যাবলীতে গুরুতর সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে তার জীবনমানের উপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ে।

শ্বাসকষ্ট

রক্তাল্পতায় অক্সিজেনের পরিবহনে কঠিনতা ঘটায়, যা শ্বাসকষ্টের মতো লক্ষণ তৈরি করে। এই শ্বাসকষ্ট সাধারণত ব্যায়াম করার সময় বা সামান্য চাপের মুখে প্রথম অনুভূত হয়ে থাকে। অবহেলা করলে এবং চিকিৎসা না নিলে, এই অবস্থা ক্রমাগত বেশি গুরুতর আকার ধারণ করে এবং উচ্চ ফলপ্রসূ কাজ করার ক্ষমতাকে হ্রাস করে দেয়।

রক্তাল্পতার প্রারম্ভিক ধাপে এই লক্ষণগুলি নির্ণয় করা গেলে, উপযুক্ত চিকিৎসা ও পুষ্টি পরামর্শ মেনে চলার মাধ্যমে ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে পেতে পারেন। তাই সচেতনতা এবং প্রারম্ভিক পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

স্বাস্থ্যঝুঁকি

হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে এটি বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য দায়ী হতে পারে। রক্তাল্পতায় শরীর যখন ভোগে, তখন অক্সিজেনের অপর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে হার্টের উপর চাপ বাড়ে, অতিরিক্ত চাপের ফলে হৃদরোগের আশঙ্কা এবং হৃদপিণ্ডের বিফলতার ঘটনাও বৃদ্ধি পায়। সুস্থ হৃদযন্ত্র সকলের জন্য অত্যন্ত জরুরি এবং হৃদরোগের আশঙ্কা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলতে পারে।

হৃদরোগের আশঙ্কা

অ্যানিমিয়ার কারণে হার্টের কাজ বেড়ে যায় কারণ এটি শরীরের সব কোষে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছানোর জন্য বাড়তি পরিশ্রম করে। ফলস্বরূপ, এটি হৃদপিণ্ডের বিফলতা বা অন্যান্য হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়ায় এবং এর ফলে আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ব্যাধি এবং স্ট্রোকের ঘটনাও ঘটতে পারে।

গর্ভাবস্থায় জটিলতা

গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে অ্যানিমিয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। অ্যানিমিয়া গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন: প্রাক-সময়ের প্রসব, নিম্ন জন্মওজনের শিশুর জন্ম, এবং শ্রমের সময় বেশি রক্তপাত। সঠিক হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বজায় রাখা একজন নারী এবং তার সন্তানের স্বাস্থ্যের জন্য নির্ণায়ক।

আরও পড়ুনঃ  পিঠে ব্যথা কিসের লক্ষণ?

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button