এলার্জি হলে কি কি সমস্যা হয়?
বিশ্বজুড়ে, প্রায় ২০% মানুষ এলার্জিক প্রতিক্রিয়া থেকে কষ্ট পাচ্ছে, যার মধ্যে খাদ্য এলার্জি ছাড়াও অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিসের মতো ত্বকের এলার্জি এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা অত্যন্ত সাধারণ। এলার্জি সমস্যার প্রকৃতি এবং তীব্রতা ব্যক্তি অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে, এবং প্রতিকারের উপায়ও বিভিন্ন। অনেক ক্ষেত্রে, এলার্জিজনিত অসুস্থতা প্রতি বছর বাড়তে থাকে, যা গভীর চিন্তার বিষয়।
বাংলাদেশের মানুষ এলার্জির প্রভাব অনুভব করেন যখন তারা পরাগমিশ্রিত বায়ু, ধুলোবালি, প্রাণীর খুলি অথবা ছত্রাকের সংস্পর্শে আসেন। এলার্জি সমস্যা অনেক সময়ে কর্মজীবনে বাধা সৃষ্টি করে, এবং ব্যক্তিজীবনেও দুর্ভোগের কারণ হয়। সন্তানদের মধ্যে এলার্জি প্রতিরোধে সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসা অতি আবশ্যক, কারণ তাদের মধ্যে এলার্জির প্রবণতা অনেক বেশি। তাই এলার্জির সঠিক জ্ঞান এবং তার উপসর্গগুলির সনাক্তকরণ জীবনযাপনের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখতে সহায়ক হবে।
এলার্জি কি?
এলার্জি মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমের একটি অতিসংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া, যা কিছু নির্দিষ্ট এলার্জেনগুলির সংস্পর্শে এসে ঘটে। যেসব উপাদান সাধারণত ক্ষতিকারক নয়, সেগুলোও কখনো কখনো শরীরের ইমিউন সিস্টেম দ্বারা হুমকি হিসেবে পরিগণিত হয়ে উঠতে পারে।
এলার্জির সংজ্ঞা
মূলত, এলার্জির সংজ্ঞায় বোঝানো হয় যে এটি এক ধরনের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, যা ইমিউন সিস্টেমের এলার্জেনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ঘটে। এই এলার্জেনগুলি খাদ্য, ধূলাবালি, পরাগ, পশুর খোলস, বিভিন্ন ধরনের ঔষধ এবং রাসায়নিক পদার্থ হতে পারে।
এলার্জির ধরন
- খাদ্য এলার্জি: যা ডিম, দুধ, বাদাম, মাছ ইত্যাদি খাওয়ার পর হতে পারে।
- পরাগ এলার্জি: বিভিন্ন মৌসুমে গাছপালা এবং ঘাসের পরাগ থেকে হয়।
- ধূলাবালি ও ডাস্ট মাইট এলার্জি: যা বাড়ির ধূলাবালি থেকে উদ্ভূত হয়।
- ঔষধ এলার্জি: পেনিসিলিন এবং সালফা ঔষধ সহ বিভিন্ন ঔষধের প্রতিক্রিয়া।
- প্রাণী এবং পশুর খোলস থেকে এলার্জি।
এই প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে যেমন হিস্টামিন নিঃসরণ ঘটায় যা সাধারণত ত্বকে চুলকানি, ফোলা বা লাল হয়ে যাবার মতো লক্ষণ সৃষ্টি করে। এলার্জির গুরুতর প্রতিক্রিয়া হিসেবে অ্যানাফিলাক্সিস ও হতে পারে, যা জীবনহানির কারণ হতে পারে।
তাই এলার্জি সম্পর্কে সঠিক ধারণা এবং সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। নিরাপদ ও সুস্থ থাকার জন্য জেনে রাখা উচিত কোন কোন বিষয় আপনার জন্য এলার্জেন হতে পারে এবং সেগুলি থেকে কিভাবে নিরাপদ থাকতে হয়।
এলার্জির সাধারণ লক্ষণ
এলার্জি লক্ষণ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে, যা সাধারনত ত্বক এবং মানসিক অবস্থা উভয়ের মধ্যে দেখা যায়। বিশেষ করে ত্বকের অ্যালার্জি এবং মানসিক পরিবর্তন এলার্জি লক্ষণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
ত্বকের সমস্যা
ত্বকের অ্যালার্জি অনেক সময় চুলকানি, খোঁচা এবং লালভাব হিসেবে দেখা দেয়। এটোপিক ডার্মাটাইটিস যা মূলত শিশুদের মধ্যে বেশি সাধারণ, ত্বকের এই ধরনের প্রদাহযুক্ত অবস্থাকে তীব্র করে তোলে। তীব্র চুলকানি ও ডার্মিস ফুলে যাও৯
- একজিমা: বিশেষত হাঁটু এবং কনুইয়ের ভাঁজে গুরুতর চুলকানির সমস্যা।
- উদ্ভিদের অ্যালার্জি: বৃক্ষ থেকে পরাগ কনা ত্বকের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়।
- পতঙ্গের কামড়: বিশেষ কিছু পতঙ্গের কামড়ের ফলে তীব্র চুলকানি ও ফোলা দেখা দেয়।
মনোভাবের পরিবর্তন
মানসিক অবস্থায় পরিবর্তন আসা সাধারণত অনেকের কাছে অস্পষ্ট এলার্জি লক্ষণ হিসেবে গণ্য হয়। তবে, এটা বেশ স্বাভাবিক যে শারীরিক অস্বস্তিকর অনুভূতি প্রধানত চাপ এবং উদ্বেগের মতো মানসিক রঙ্গিন অবস্থাঁর রিং ধরে চলে। যে সকল লক্ষণ অত্যন্ত তীব্র হয়, তা মানসিক চাপের কারণে আরও প্রকট হতে পারে।
- চাপ মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষেত্রে একটি মুখ্য উপাদান।
- অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ায় উদ্বেগ বাড়ে, যা শরীরের প্রতিক্রিয়াকে আরও জটিল করে তোলে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রান্ত সমস্যা
এলার্জি থেকে যে সমস্ত শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়, তার মধ্যে হাঁপানি, নাসারোধ, এবং কফ প্রধান। এসব সমস্যা বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
হাঁপানির আকস্মিকতা
হাঁপানি হল শ্বাস-প্রশ্বাসের নালীর অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হয়ে যাওয়া এবং মিউকাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। এটি অনেক সময় আকস্মিক হয়ে থাকে, যেমন খাদ্য বা পরাগের সংস্পর্শে এসে। উল্লেখযোগ্য হল, বিভিন্ন ধরণের হাঁপানি, যেমন মৃদু থেকে গুরুতর অবস্থার পর্যন্ত বিদ্যমান, যা নির্ভর করে উদ্দীপকের প্রকার ও ব্যক্তির সংবেদনশীলতার উপর।
নাসারোধের সমস্যা
নাসারোধ সাধারণত নাকের ভিতরের প্রদাহজনিত সংকোচনের ফলে হয়। এটি যেমন ধুলো, ধোঁয়া বা পেশাগত কারণে বিভিন্ন ধরণের অতিসক্রিয়তা হতে পারে। বিশেষত, ফুলের পরাগ বা পোষা প্রাণীর খুশকির সংস্পর্শে এসে নাসারোধ হতে পারে।
কফের সমস্যা
কফ হল শ্বাসনালীর প্রদাহের ফলে উত্পন্ন একটি প্রতিক্রিয়া যা শ্বাস-প্রশ্বাসকে ব্যাহত করে। লক্ষণগুলি হতে পারে মৃদু কাশি থেকে শুরু করে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী কাশি পর্�
খাদ্যের সঙ্গে এলার্জি
খাদ্য এলার্জি এমন একটি সমস্যা যা বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। এটি যখন ঘটে, শরীর কিছু খাদ্যকে হুমকি হিসেবে গ্রহণ করে এবং প্রতিরক্ষা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়। জেনে নেওয়া যাক এই প্রতিক্রিয়াগুলি কী কী হতে পারে এবং কীভাবে নিরাপদ খাদ্য পরিকল্পনা এলার্জি প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
খাদ্য এলার্জির লক্ষণ
খাদ্য এলার্জির লক্ষণগুলো খুব দ্রুত উপস্থিত হতে পারে এবং এগুলো মৃদু থেকে গুরুতর পর্যায়ে বিভক্ত হতে পারে। চিনাবাদাম সংবেদনশীলতার মতো খাদ্য এলার্জি অনেক সময় তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটায়। এর কিছু সাধারণ লক্ষণ হলঃ
- মুখ, জিভ, বা ঠোঁটের ফোলা
- চুলকানি বা র্যাশ
- বমি করা বা পেটের ব্যথা
- শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি
নিরাপদ খাদ্যের তালিকা
এলার্জি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলার জন্য নিরাপদ খাদ্যের তালিকা একটি উপকারী সংস্থান হতে পারে। বাজারে বিভিন্ন রকমের অ্যালার্জিন উপস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ খাদ্য চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ:
- ডিম ও দুধজাত খাবারে এলার্জি থাকলে সয়া বা বাদামভিত্তিক দুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
- গম এবং গ্লুটেন এলার্জি থাকলে চাল, কর্নফ্লাওয়ার বা আলুর ফ্লাওয়ার ভালো বিকল্প।
- নাট এলার্জি থাকলে বীজজাতীয় খাবার যেমন তিল বা সূর্যমুখীর বীজ উপযুক্ত হতে পারে।
এসকল তথ্যের সাহায্যে খাদ্য এলার্জির ঝুঁকি কমানো এবং নিরাপদ খাদ্য ভোগের পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব
বাংলাদেশে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বিভিন্ন ধরণের প্রভাব পড়ে। বিশেষত, মৌসুমি এলার্জি ও ধুলাবালির প্রভাব অনেক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তোলে।
মৌসুমি এলার্জি
মৌসুমি এলার্জি প্রধানত গরম বা ঠান্ডা আবহাওয়াতে বেশি দেখা দেয়। ফুলের পরাগ রেণু থেকে শুরু করে বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন ধরণের অ্যালার্জেন, মানুষের নাসিকা পথ ও শ্বসন তন্ত্রে প্রবেশ করে। যা হাঁচি, গলা ও চোখ চুলকানি, নাক বন্ধ হওয়ার মতো সমস্যাগুলির কারণ হয়।
- প্রতিবছর বসন্ত ও শরৎ মৌসুমে এলার্জির প্রকোপ বাড়ে।
- অ্যান্টিহিস্টামিন, ডিকংজেস্ট্যান্ট মতো ওষুধের চাহিদা এসময় বেড়ে যায়।
- এলার্জি প্রতিরোধে ঘরের মধ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত জরুরি।
ধুলাবালির এলার্জি
ধুলাবালির প্রভাব মানুষের রোজকার জীবনে বড় একটা সমস্যা তৈরি করে। এমনকি এটি অ্যাস্থমা ও সাইনাসের মতো রোগের অবস্থা খারাপ করে দিতে পারে।
- ধুলাবালির মধ্যে থাকা ডাস্ট মাইটস ও মোল্ড অনেক সময় এলার্জিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়।
- বাড়ির কার্পেট, পর্দা এবং আসবাবপত্র ধুলাবালির বড় উৎস।
- নিয়মিত ভ্যাকুয়ামিং এবং আসবাব পরিষ্কার করা অত্যন্ত জরুরি।
সামগ্রিকভাবে, গরম বা ঠান্ডা আবহাওয়া এবং ধুলাবালির প্রভাব মৌসুমি এলার্জি ও ধুলাবালির এলার্জি উভয়েরই ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সকলের উচিত এর প্রতি যথেষ্ট সচেতন থাকা এবং সঠিক প্রতিরোধক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এলার্জি ও শিশুদের সমস্যা
শিশুদের মধ্যে এলার্জির প্রবণতা যথেষ্ঠ বেশি থাকা সত্ত্বেও প্রায় সময়ই এই সমস্যাটি উপেক্ষা করা হয়। শিশুদের এলার্জি এবং শিশুর স্বাস্থ্যে উদ্ভূত ঝুঁকিগুলি সনাক্ত করা এবং প্রতিরোধের পন্থাগুলি অবলম্বন করা জরুরি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনুমোদিত, এম কোল্ড সি জেড সিরাপ একটি এন্টিহিস্টামাইন ড্রাগ যা শিশুদের এলার্জি প্রতিক্রিয়ার সময়ে শরীরে তৈরি হিস্টামাইনকে ব্লক করে।
শিশুর শরীরে এলার্জির লক্ষণ
শিশুদের মধ্যে এলার্জির সাধারণ লক্ষণ হিসাবে কাশি, জ্বর, রক্তপাতময় নাক, উল্টানো এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায়। এম কোল্ড সি জেড সিরাপ এই ধরনের সমস্যাগুলির চিকিৎসায় কার্যকর। যদিও এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলি শিশুর বয়সের উপর নির্ভরশীল, তাই ডাক্তারের পরামর্শ অবলম্বন করা উচিত। ক্লোরফেনিরামিন, যা চোখের যন্ত্রণা, সাধারণ ঠাণ্ডা, জ্বর, থ্রোট বা স্কিনের চুলকানি সহ বিভিন্ন শর্তে ব্যবহৃত হয়, এর একটি বিকল্প।
প্রতিরোধের উপায়
এলার্জি প্রতিরোধের উপায় হিসাবে শিশুদের তাদের এলার্জেনের সাথে মুখোমুখি না করানো, শিশুদের জন্য নিরাপদ অ্যান্টি-হিস্টামিনস ব্যবহার এবং তাদের ইমিউন সিস্টেম বর্ধিত করার উপায় খুঁজে নেওয়া জরুরি। ক্লোরফেনিরামিনের প্রচলিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াসমূহের মধ্যে লিভারের ক্ষতি, মাথা ঘোরা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমি ভাব, দৃষ্টি ঝাপসা, শরীরের এলার্জিক প্রতিক্রিয়া এবং দ্রুত হৃৎপিণ্ডের হার অন্তর্ভুক্ত। এই কারণে, শিশুদের চিকিৎসায় বিকল্প হিসেবে সারপিল ট্যাবলেট, বেনাকফ 2 মিগ্রা/ 500 মিগ্রা/ 5 মিগ্রা ট্যাবলেট, ড্রিস্টান কোল্ড ট্যাবলেট, এবং থার্মাল-এস 2 মিগ্রা/500 মিগ্রা/5 মিগ্রা ট্যাবলেট ব্যবহার উপযুক্ত হতে পারে। অতএব, অভিভাবকেরা উচিত চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে তাদের শিশুদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা নির্বাচন করা।