বাইপোলার ডিসঅর্ডার কেন হয়? – কারণ ও তথ্য

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের উৎপত্তি একটি জটিল প্রশ্ন যার পূর্ণাঙ্গ উত্তর এখনো আমরা জানি না; তবে এটা স্পষ্ট যে এর মধ্যে রয়েছে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন যা ম্যানিয়া এবং ডিপ্রেশনের এপিসোডের মতো বৈশিষ্ট্যযুক্ত। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ মানসিক চ্যালেঞ্জ, যা এক দিন উচ্চশিরে হর্ষ অনুভব থেকে অন্য দিনে গভীর বিষন্নতায় পরিবর্তিত হয়, দীর্ঘমেয়াদী রোগ হিসেবে এর চিহ্নিত করা যায়।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ইউকে ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ বলছে প্রায় প্রতি ১০০ জনের মধ্যে একজন তাদের জীবনে কোন না কোন পর্যায়ে ম্যানিয়া এপিসোড অথবা ডিপ্রেশন এপিসোড অনুভব করে থাকেন। বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপ অনুযায়ী, প্রতি ১০০০ জনে চারজন এই মনোদৈহিক মুড ডিসঅর্ডার দ্বারা প্রভাবিত। বাইপোলার ডিসঅর্ডার যেহেতু জিনগত বা পারিবারিক হতে পারে, তাই এর উপস্থিতি ও প্রকোপের পেছনে জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণগুলিও বিবেচনা করা হয়।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ

বাইপোলার ডিসঅর্ডার, যাকে ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ ইলনেস হিসেবেও জানা যায়, একটি মানসিক অবস্থা যা ব্যক্তির উচ্ছ্বাস ও বিষণ্ণতা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এই অবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হল মুড এপিসোড যা ম্যানিয়া বা হাইপোম্যানিয়া এবং ডিপ্রেশন এপিসোডের মধ্যে দোলাচল করে। এই শ্রেণীবিভাগ তিনটি প্রধান ধরণের মধ্যে বিভক্ত।

বাইপোলার 1 ডিসঅর্ডার

এই ধরণের ডিসঅর্ডারে ব্যক্তি এক বা একাধিক ম্যানিয়া এপিসোড অনুভব করেন, যা সাধারণত এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে থাকে। এই ম্যানিয়া এপিসোডের পাশাপাশি, প্রায়শই ডিপ্রেশন এপিসোড হওয়ার ঘটনা ঘটে, যা দুই সপ্তাহের অধিক সময় ধরে বিরাজ করতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  পুষ্টি কি? জানুন বিস্তারিত

বাইপোলার 2 ডিসঅর্ডার

বাইপোলার 2 ডিসঅর্ডারে মানুষজন হাইপোম্যানিয়া এবং ডিপ্রেশন এপিসোডের সম্মিলনে ভুগে থাকেন। এখানে, হাইপোম্যানিয়া একটি হালকা ধরণের ম্যানিয়া যা মানসিক অবস্থার চড়াই-উতরাইয়ের কম তীব্রতায় প্রকাশিত হয়। এই এপিসোডগুলি সাধারণত কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকে।

সাইক্লথমিয়া

সাইক্লথমিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডারের একটি হালকা রূপ, যেখানে ব্যক্তির মানসিক অবস্থা উচ্ছ্বাস এবং বিষণ্ণতার মধ্যে মৃদু ভাবে ওঠানামা করে। এই অসুস্থতা হতে পারে দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে, তবে এর এপিসোডগুলি পূর্ণ ম্যানিয়া বা ডিপ্রেশন এর এক্সট্রিম পর্যায়ে পৌঁছায় না।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণ ও উপসর্গ

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের বৈশিষ্ট্যযুক্ত লক্ষণ ও উপসর্গ বোঝা জরুরি। ধারণা করা হয় যে এই উপসর্গগুলোর মধ্যে মানসিক ম্যানিয়া লক্ষণ, ডিপ্রেশন উপসর্গ, এবং সামাজিক যোগাযোগের সমস্যা অন্তর্ভুক্ত থাকে যা ব্যক্তির রুটিন প্রভাবিত করে থাকে।

ম্যানিয়া এবং হাইপোম্যানিয়া

ম্যানিয়া লক্ষণ অত্যন্ত জটিল, এতে ব্যক্তি অস্বাভাবিক উচ্ছ্বাস, অতিরিক্ত শক্তি, এবং খুব কম ঘুমের প্রবণতা দেখায়। এটি ব্যক্তির কার্যক্ষমতা এবং সামাজিক যোগাযোগকে প্রভাবিত করে।

বিষণ্ণতা

বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন উপসর্গ আশাহীনতা, চঞ্চলতা, আগ্রহের অভাব, এবং একাকী অনুভূতি দ্বারা চিহ্নিত। এই উপসর্গগুলি ব্যক্তির দৈনন্দিন কর্মক্ষমতা এবং সামাজিক যোগাযোগকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

সহাবস্থান সমস্যা

সহাবস্থান সমস্যা হলো যখন বাইপোলার ডিসঅর্ডার অন্যান্য মানসিক বা শারীরিক রোগের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই ধরনের সমস্যা ব্যক্তির মুড এপিসোড এবং রুটিন প্রভাবিত করে। অফিসের কাজ থেকে সামাজিক জীবন পর্যন্ত সব কিছুতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

জীনগত কারণ: বাইপোলার ডিসঅর্ডারের অংশ

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের বিকাশে জেনেটিক্যালি বাইপোলার প্রভাব অসামান্য, যা প্রায়ই বংশগত কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই মানসিক রোগের প্রবণতা জিন গবেষণা দ্বারা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা পরিবারের ইতিহাসে এর উপস্থিতি নির্দেশ করে।

পরিবার এবং জিনের ভূমিকা

বংশগত কারণগুলি মুখ্যত বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। পরিবারের একাধিক সদস্য যদি এই রোগে ভুগে থাকেন, তাহলে উপর্যুক্ত প্রজন্মের মধ্যে এর উপস্থিতির সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।

আরও পড়ুনঃ  রক্তে SGPT বেড়ে গেলে কি হয়?

গবেষণার ফলাফল

  • প্রায় 50 জন প্রাপ্তবয়স্ক মধ্যে 1 জন তার জীবনকালে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারেন।
  • এই ডিসঅর্ডারের প্রথম উপসর্গ সাধারণত 15 থেকে 25 বছর বয়সে শুরু হয় এবং 50 বছরের পরে এর উদ্ভব বিরল।
  • জিন গবেষণা দেখায় যে মানসিক রোগ যেমন বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা স্কিজোফ্রেনিয়া পরিবারের ইতিহাসে থাকলে, তারা বাড়তি রিস্কে থাকে।

পরিবেশগত উপাদানগুলির প্রভাব

বাইপোলার ডিসঅর্ডারে পরিবেশগত উপাদানগুলির ভূমিকা অনন্য। এই উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে মানসিক চাপ প্রভাব, জীবনধারার পরিবর্তন এবং সামাজিক সমর্থন, যা স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার উপর গভীর প্রভাব ফেলে।

মানসিক চাপ

মানসিক চাপের প্রভাব বাইপোলার ডিসঅর্ডারের প্রকোপ বাড়াতে পারে। চাকরির চাপ, পারিবারিক সমস্যা, অথবা অর্থনৈতিক দুর্দশা—এই সব কারণে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় যা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলিকে উস্কে দেয়। পরিবেশগত উপাদান হিসেবে মানসিক চাপ একটি প্রধান উপাদান।

জীবনধারার পরিবর্তন

জীবনধারার পরিবর্তন যেমন বিয়ে বা ডিভোর্স, বাবা-মা হওয়া, নতুন চাকরি অথবা চাকরি হারানো, যা স্ট্রেস সৃষ্টি করে এবং সামাজিক সমর্থন এর প্রয়োজনীয়তাকে বাড়িয়ে তোলে। এই ধরনের পরিবর্তনগুলি মানসিক স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং পৌনঃপুনিক উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।

সামাজিক সমর্থনের গুরুত্ব

বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সামাজিক সমর্থন অত্যন্ত জরুরী। পরিবার, বন্ধু, এবং পেশাদারি সাহায্য যেমন মনোচিকিৎসক ও কাউন্সেলরদের সমর্থন মানসিক স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধারে এবং ব্যক্তির জীবনধারায় স্থিতিশীলতা আনতে সাহায্য করে। একটি শক্তিশালী সামাজিক নেটওয়ার্ক মানসিক চাপ কমাতে ও অস্থিরতা মোকাবেলা করতে অপরিহার্য।

রাসায়নিক ভারসাম্য এবং মস্তিষ্ক

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের পিছনে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় মস্তিষ্কের রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। নিউরোট্রান্সমিটার ভারসাম্যহীনতা এবং মস্তিষ্কের গঠন এই দুটি ফ্যাক্টর খুব গুরুত্বপূর্ণ।

নিউরোট্রান্সমিটারসমূহ

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের প্রধান কারণ হিসেবে নিউরোট্রান্সমিটার যেমন সেরোটোনিন, ডোপামিন এবং নরঅ্যাড্রেনালিনের ভারসাম্যহীনতা চিহ্নিত হয়। এই রাসায়নিকগুলির ঘাটতি অথবা অতিরিক্ত মাত্রা বাইপোলার লক্ষণগুলির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

আরও পড়ুনঃ  কালো থেকে ফর্সা হওয়ার উপায়

মস্তিষ্কের গঠনগত পার্থক্য

গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের মস্তিষ্কের গঠনে পার্থক্য রয়েছে, তাদের মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই গঠনগত ভিন্নতা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের ক্রিয়াকলাপে প্রভাব ফেলে, যা পরবর্তীতে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা পদ্ধতি

বাংলাদেশে, প্রায় প্রতি হাজার জনের মধ্যে চার জন বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হোন, এবং এর নিদর্শনগুলি শিশু থেকে প্রবীণ পর্যন্ত যে কোনো বয়সে দেখা দিতে পারে। ঠিকমতো নির্ণয় ও সময়োচিত চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু যথাযথ যত্ন না হলে ব্যক্তি নিজের ও অন্যের ওপর হিংসাত্মক আচরণের মতো গুরুতর পরিণতির সম্মুখীন হতে পারে।

ওষুধের ভূমিকা

ঔষধ পরিকল্পনা বাইপোলার ডিসঅর্ডার চিকিৎসার অন্যতম মূলভিত্তি। একজন ব্যক্তি যখন ম্যানিয়া বা বিষণ্ণতার লক্ষণ দেখায়, তখন কোলা ২০ এম জি ট্যাবলেটের মতো ওষুধের প্রয়োগ হতে পারে, বিশেষ করে ১৮ বছরের উপরে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। তবে, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে চিকিৎসা পরিচালনা করা উচিত, এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলির প্রতি সঠিক মনোযোগ দিয়ে অতিরিক্ত ব্যবহারের ঝুঁকি এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ।

থেরাপির বিভিন্ন ধরন

মানসিক স্বাস্থ্য থেরাপি ব্যক্তির চিন্তা, আচরণ এবং সামাজিক মিত্রতা উন্নত করার জন্য অপরিহার্য। এর অন্তর্গত থেরাপি শৈলীগুলি হল কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT), ইন্টারপারসোনাল এবং সামাজিক তালগত থেরাপি (IPSRT), এবং অন্যান্য গ্রুপ থেরাপিসমূহ। এসব থেরাপির মাধ্যমে, রোগীরা তাদের আবেগ ও আচরণগত প্রতিক্রিয়াগুলি বোঝা এবং নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে।

জীবনযাত্রার পরিবর্তন

জীবনযাত্রা পরিবর্তন অভ্যাসগত এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমের আশেপাশে ভিত্তি করে এবং এটি চিকিৎসার এক অনুপ্রেরণাদায়ক দিক। সুস্থ খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং যথাযত ঘুমের অভ্যাস মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করে যা বাইপোলার ডিসঅর্ডার চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরও কি, ধূমপান ও মদ্যপান পরিত্যাগ, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং সামাজিক সম্পর্ক উন্নত করা—এই সব কঠিন আচরণগুলি একটি সফল চিকিৎসা পথ তৈরি করে।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button