জহির রায়হান

জহির রায়হান একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, উপন্যাসিক ও গল্পকার। তিনি ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ফেনিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হন। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অবদান অসীম।

জহির রায়হানের জীবনীতে সমৃদ্ধ তাঁর সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র কর্মজীবন। বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশে বাঙালি সাহিত্যিক হিসাবে তাঁর অবদান অতুলনীয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ ডকুমেন্টারিটি তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ।

প্রারম্ভিক জীবন

জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ও পরিবার তাঁকে প্রারম্ভিক জীবনে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পিতা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ একজন শিক্ষক ছিলেন এবং তাঁর দীক্ষার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৭ সালে, ভারত বিভাগের সময় তাঁদের পরিবার বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসে।

জহিরের শিক্ষা জীবন ঢাকায় শুরু হয় এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর জন্ম ও পরিবার থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণা এবং শিক্ষার ভিত্তি ফলে সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রে তাঁর সফল ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে।

সাহিত্যিক কর্মজীবন

জহির রায়হান তার সাহিত্যিক কর্মজীবনে অসাধারণ উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন। তার প্রথম উপন্যাস “শেষ বিকেলের মেয়ে” প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। এরপর ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস “হাজার বছর ধরে”, যেটি তার লেখকজীবনের অন্যতম প্রভূত সাফল্য অর্জন করে। তিনি ১৯৬৫ সালে উপন্যাসটি জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।

তারপর ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় আরেক বিখ্যাত উপন্যাস “আরেক ফাল্গুন”। এই উপন্যাসগুলোতে তিনি সমাজের বাস্তব চিত্র নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন, যা তাকে পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন দিয়েছে। এছাড়া তার গল্পগ্রন্থ “সূর্যগ্রহণ” প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে, যা তাকে সত্তর দশকের শীর্ষস্থানীয় লেখকদের কাতারে উন্নীত করে।

জহির রায়হান তার ছোটোগল্পে দক্ষতা দেখিয়েছেন, যেমন “তৃষ্ণা” (১৯৬২) এবং “জাতুগৃহ” (১৯৭০)। এসব গল্পগ্রন্থে তিনি শৈল্পিক ও সাহিত্যিক সক্ষমতা প্রকাশ করেছেন, যা তাকে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে অমর করে তুলেছে। তিনি তার অসামান্য সাহিত্যকর্মের জন্য ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।

আরও পড়ুনঃ  সালমান শাহ

তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থগুলোর পাশাপাশি, তিনি “কন্যকাতা”, “শ্রাবণ মেঘের দিন”, “শোকিন”, “অপেক্ষা ও নিশ্চিত” সহ আরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন। তার সাহিত্যশক্তি ও প্রতিভার প্রমাণ অপরিসীম, যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

জহির রায়হানের জীবন ও কাজ তার সাহিত্যিক কর্মজীবনের মাইলফলক হয়ে থাকবে। তার উপন্যাস ও গল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশি সাহিত্যকে নতুন মাত্রায় উন্মোচিত করেছেন এবং তার মেধার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

চলচ্চিত্র জগতে আগমন

জহির রায়হানের প্রথম চলচ্চিত্র “কখনো আসেনি” ১৯৬১ সালে মুক্তি পায়। তার এই প্রথম চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে একটি মাইলফলক হিসেবেও পরিচিত। ১৯৬৪ সালে তিনি “কাঁচের দেয়াল” নামক প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যা তাকে সুপরিচিত চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

জহির রায়হানের চলচ্চিত্র জগতের আগমনটি ছিল গৌরবময় ও বহু প্রতিভার পরিচায়ক। তার পরিচালিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে “সোনার কাজল” (১৯৬২), “সঙ্গম” (১৯৬৪), “বাহানা” (১৯৬৫), “বেহুলা” (১৯৬৬), “আনোয়ারা” (১৯৬৭), এবং “জীবন থেকে নেয়া” (১৯৭০) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

তাঁর চলচ্চিত্রগুলি বাংলাদেশের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে উপলব্ধি করিয়ে দেয়, যা তখনকার সময়ের জন্য ব্যতিক্রমী ছিল। তিনি শ্রেষ্ঠ কাজগুলির জন্য বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেন। প্রথম চলচ্চিত্র থেকেই তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করতে সক্ষম হন এবং তার কাজগুলি আজও সমাদৃত।

জহির রায়হানের প্রথম চলচ্চিত্র “কখনো আসেনি” মুক্তি পাওয়ার বর্ষেই তিনি চলচ্চিত্র শিল্পে তার বিচক্ষণতা ও প্রতিভা দেখিয়েছেন, যা পরবর্তী কয়েক দশক ধরে প্রভাব ফেলেছে। তার চলচ্চিত্র কর্মজীবন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

খ্যাতনামা চলচ্চিত্র

জহির রায়হান বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তার অনন্য সৃষ্টির মাধ্যমে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করেছেন। তার পরিচালিত খ্যাতনামা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল জিবন থেকে নেওয়া, বেহুলা, এবং সঙ্গম

আরও পড়ুনঃ  মাসুমা রহমান নাবিলা

১৯৬১ সালে তার প্রথম চলচ্চিত্র কখনও আসেনি মুক্তির পর থেকেই জহির রায়হানের নির্মিতিক দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা সবার নজরে আসে। জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রটি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র, যা তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়।

অপরদিকে, বেহুলা, যা ১৯৬৬ সালে নির্মিত হয়, পুরাণ কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয়েছে। বিখ্যাত এই চলচ্চিত্রটি জহির রায়হানের পরিচালনার দক্ষতাকে ফুটিয়ে তুলেছে এবং দর্শকদের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছে।

তাছাড়া, সঙ্গম ছিল প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র যা ১৯৬৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল। এটি শুধু এশিয়ার চলচ্চিত্র দেখার ধরণ বদলায়নি, বরং দর্শকদের অভিজ্ঞতায়ও নতুনত্ব এনেছে।

এইসব চলচ্চিত্রের সাফল্যের পেছনে জহির রায়হানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রতি তার সংবেদনশীলতা, এবং তার নিজস্ব সৃজনশীলতা ভূমিকা রেখেছে।

স্টপ জেনোসাইড

১৯৭১ সালে মুক্তি প্রাপ্ত “স্টপ জেনোসাইড” জহির রায়হান পরিচালিত একটি শক্তিশালী স্টপ জেনোসাইড ডকুমেন্টারি। এই ২০ মিনিট ব্যাপ্তির ডকুমেন্টারিটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা ও গণহত্যার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে।

ডকুমেন্টারিটির নির্মাণ বর্ণনামূলক এবং অন্তর্ভুক্ত করার মতো উদ্যোগ নেওয়া হয় যেখানে বিভ্রান্তিকর কোনও রব মৃদু ছিল না। যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে এতে তর্কাতীতভাবে সাহসী প্রচারাভিযান হিসেবে প্রমাণিত হয়। জহির রায়হানের সাথে আরও যারা যৌথভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন বাবুল চৌধুরী, দেবব্রত সেন গুপ্ত, চিত্ত বর্ধন এবং অরুণ রায়। স্টপ জেনোসাইড ডকুমেন্টারিটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয়, বিশ্বব্যাপী মানুষের সহানুভূতি কাড়ার লক্ষ্যে ৩৫ মি.মি. ফিল্মে ধারণ করা হয়েছিল।

স্টপ জেনোসাইড ডকুমেন্টারিটির প্রেক্ষাপটে ভয়ঙ্কর সত্য উন্মোচন করা হয়, যা আন্তর্জাতিক ফোরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। বহুল প্রশংসিত ও সমাদৃত এ ডকুমেন্টারিটি প্রথম প্রদর্শিত হয় মুজিবনগর সরকার এবং নির্বাসিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সামনে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এটিতে আবেগপ্রবণ হয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র বিভাগকে নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শনের জন্য এটি ক্রয় করতে।

  • প্রথম মুক্তি: ১৯৭১
  • ব্যাপ্তিকাল: ২০ মিনিট
  • পুরস্কার: ১৯৭২ সালে তাশখন্দ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এবং ১৯৭৫ সালে দিল্লি চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত
  • ইন্দিরা গান্ধীর সমর্থন: আন্তর্জাতিক প্রদর্শনের জন্য ক্রয় নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে
আরও পড়ুনঃ  তাসনিয়া ফারিণ

এই স্টপ জেনোসাইড ডকুমেন্টারি শুধুমাত্র তথ্যচিত্র নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রয়ে গেছে, যা পরবর্তীতে মুক্তিকামী মানুষের জন্য প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে রয়েছে।

Zaheer Raihan এবং বাংলা সিনেমা

জহির রায়হান বাংলা সিনেমার জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তাঁর পরিচালিত ছয়টি চলচ্চিত্র তৎকালীন ১৯৬০-এর দশকে বাংলা সিনেমার গতি ও গাম্ভীর্য বাড়িয়ে তোলে। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত ‘সূর্যগ্রহণ’ দিয়ে তার সাহিত্যিক যাত্রা শুরু হয়, যা তাকে বাংলা সাহিত্য ও সিনেমার প্রাঙ্গণে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।

রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৬৯) শুধুমাত্র বাংলা সিনেমায় নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও এক নতুন মাত্রা যোগ করে। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ এবং ঋত্বিক ঘটকদের মতো প্রখ্যাত নির্মাতারা এ চলচ্চিত্রের প্রশংসা করেছিলেন। রায়হান পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪) এবং তার পরের বছর সৃজনশীলভাবে বানানো ‘বাহানা’-এর মাধ্যমে সিনেমাস্কোপ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে।

বাংলাদেশি সিনেমা জগতের সঙ্গে রায়হানের সম্পর্ক গভীর। তিনি ভাষা আন্দোলনের সময় কারাগারে থাকাকালীন “আরেক ফাল্গুন” উপন্যাসটি লিখেছিলেন, যা তাঁর সাহিত্যকর্মের অন্যতম দৃষ্টান্ত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি তার দুটি ২০ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র – ‘স্টপ জেনোসাইড’ এবং ‘অ স্টেট ইজ বর্ন’ তাকে একধাপ এগিয়ে রাখে। জহির রায়হানের বাংলা সিনেমা অবদান তার সিনেমায় প্রতিফলিত হয়। এটি বাঙালি জাতির সংগ্রামী ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক ছবির রূপ দেয়।

বর্তমান সময়ে বিশেষ করে ২০২৩ সালে ৫১টি পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশী চলচ্চিত্রশিল্পটি প্রায় ১১০ কোটি টাকার মার্কেটে পরিণত হয়েছে। এ শিল্পে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, টাইগার মিডিয়া, জাজ মাল্টিমিডিয়া, মনসুন ফিল্মস, আলফা-আই স্টুডিওস, চর্কি, বঙ্গ, ভারসেটাইল মিডিয়া, লাইভ টেকনোলজিস এবং দি অভি কথা চিত্রা মূল বিতরণকারীর কাজ করে যাচ্ছেন। জহির রায়হানের মতো পথিকৃৎ নির্মাতারা যে বীজ বপন করেছিলেন, আজকের বাংলা সিনেমা সেই চেতনার ধারাবাহিকতায় সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Back to top button